স্টাফ রিপোর্টার, নেত্রকোণা:
নেত্রকোণার খালিয়াজুরি উপজেলার জাহেরপুর গ্রামের দিনমজুর লিয়াকত আলী (৫০)। হাওরের প্রচণ্ড বাতাস, ঢেউ কিংবা আফালের ভাঙনে গত তিন দশকে অন্তত পাঁচবার থাকার জায়গা পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে। দুর্গম হাওরাঞ্চলের শ্রবণ প্রতিবন্ধী বৃদ্ধা লাকজানেরন্নেছা (৭০), বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী তিন সন্তান রিপা মণি (১৬), লিটন মিয়া (১২), তরিকুল মিয়াসহ (৬) সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে অন্যের জায়গায় একটি ছাপরা ঘর করে বসবাস করেছেন প্রায় বিশ বছর।
বর্ষাকাল শুরু হলেই বছরের প্রায় অর্ধেক সময় তাদের কাটাতে হতো আতঙ্কের মধ্যে। এখন আর সেই দুশ্চিন্তা নেই। পরিবার নিয়ে পাকা বাড়িতে বসবাস করছেন তারা। খালিয়াজুরি উপজেলা প্রশাসন তাকে সেমি পাকা একটি বাড়ি বুঝিয়ে দেয়। প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে শেষ বয়সে এ আশ্রয় পেয়ে তিনি অনেকটাই স্বস্তিতে আছেন।
তিনি বলেন, ‘অহন থাইক্কা শান্তিতে ঘুমাইতে পারি। কোনো রইদ বৃষ্টি আয়ে না।’ ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে বাড়িটিতে রয়েছে দুটি করে শোবার ঘর, একটি করে রান্না ঘর, শৌচাগার ও ঘরের সামনে রয়েছে একটি বারান্দা।
শুধু লিয়াকত আলীই নন, খালিয়াজুরি উপজেলাতে এমন পাকা বাড়ি পেয়েছেন
৪৪৩টি পরিবার। আরও ৪০০টি পরিবারের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে।
গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাওরাঞ্চলের ওই উপজেলার মুজিবনগর, জাহেরপুর, শ্যামপুর, যাদবপুরসহ সাতটি গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, ছোট্ট ছোট্ট গ্রামগুলোতে রঙিন এসব ঘর শোভা পাচ্ছে।
ময়মনসিংহ বিভাগের ভৌগোলিকভাবে একমাত্র হাওর উপজেলা খালিয়াজুরিতে প্রথম ধাপে ৪৪৩ জন গৃহহীন মানুষকে জায়গাসহ দেয়া হয় সেমিপাকা বাড়ি।
উপকারভোগীরা সরকারের দেয়া বাড়িটিকে দেখছেন ‘জীবনের সেরা উপহার’
হিসেবে। হাওরাঞ্চলের ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী ভূমিহীন ছিন্নমূল মানুষেরা এক সময়
ঝড় বৃষ্টিতে আতঙ্কে থাকতেন। তাদের নিশ্চিন্ত জীবন ব্যবস্থা করে দেয়ায় খুশিতে ভাসছেন তারা।
স্থানীয়রা জানায়, আর মাসখানেকের মধ্যে যখন বর্ষা শুরু হবে তখন প্রায় সাত মাস এসব বাড়ির চারদিকে শুধু পানি আর ঢেউয়ের খেলা হবে। উপজেলা সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মুজিবনগর গ্রামটির ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ১৯৯৬ সালে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছানোয়ারুজ্জামান তালুকদার একটি প্রকল্প তৈরি করে হাওরের মাঝে প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সরকারি জায়গায় গ্রামটি স্থাপন করেন। পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে গ্রামের নামকরণ করেন তিনি। বর্তমানে গ্রামটিতে প্রায় দেড় হাজার মানুষ বসবাস করছে। ওই গ্রামে ৭৩টি পরিবারের মধ্যে পাকা ঘর হস্তান্তর করেছে উপজেলা প্রশাসন।
গত এক সপ্তাহ আগে নতুন ঘরে উঠেছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী বিধবা আয়েশা খাতুন (৬৫)। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী আব্বাস আলী ভুঁইয়া ১০ বছর
আগে মইরা গেছে। এক ছেলে ও দুই মেয়ে, তারারে বিয়া দেওনের পর কেউ দেহে না আমারে। আমি প্রতিবন্ধী ভাতা ও মাইনসের সাহায্য দিয়া চলি। আমার কোনো ঘর আছিলো না। মাইনসের একটা ভাঙা ঘরে থাকতাম। বাইষা মাসে ঘরের চালের ছিদ্রি দিয়া পানিতে সব ভিজতো। আমি ঘরে ছাতি টাঙাগাইয়া থাকতাম। এমন মাগনামাগনি পাক্কা বাড়ির মালিক হইয়াম এইডা জীবনেও ভাবতাম পারছিলাম না।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মুজিব শতবর্ষে দেশের
কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন নির্দেশনা
বাস্তবায়নে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে।
জেলার ১০টি উপজেলায় প্রথম পর্যায়ে ৯৬০টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়। এরমধ্যে
খালিয়াজুরিতে ৪৪৩টি ঘর রয়েছে। সব ঘরের কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন
সুবিধাভোগীদের হস্তান্তর করা হচ্ছে।
খালিয়াজুরি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) রাজিব আহমেদ
জানান, দুইটা ধাপে বরাদ্দকৃত ঘরের মধ্যে রয়েছে খালিয়াজুরি সদর ইউনিয়নের
খালিয়াজুরি গ্রামে ২টি, মুজিব নগরে ৭৩টি, মুমিন নগরে ৩৬টি, আদাউড়ায়
২৬টি, যোগীমারায় ২৪টি, রোয়াইলে ৩৩টি, লক্ষ্মীপুরে ৬৭টি, চাকুয়া
ইউনিয়নের হাতিলা ছমিরপুরে ৪৩টি, কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের শ্যামপুরে ৩০টি,
যাদবপুরে ৩১টি, জাহেরপুরে ১২৪টি, নগর ইউনিয়নের গন্ডামারায় ২৩টি,
সগ্রাখাইয়ে ২৮টি, আদমপুরে ২৩টি, বল্লভপুরে ৪টি, মেন্দিপুর ইউনিয়নের
রসুলপুরে ৪টি, নূরালীপুরে ৫৪টি ও আসাদপুরে ১টি, জগন্নাথপুরে ১৯টি,
বীরবিল্লায় ১১টি ও গাজীপুর ইউনিয়নের বয়রা গ্রামে ১৮৭টি ঘর।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এএইচএম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘হাওরে রাস্তাঘাটের সমস্যায় নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনে কষ্ট হলেও কাজের গুণগতমান ঠিক রেখে ৪৪৩টি ঘর তৈরিতে আমি সবার সহযোগিতা পেয়েছি। ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার মো. কামরুল হাসান ও জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমান স্যারের নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রকল্প বাস্তবায়নে সাহস যুগিয়েছেন। যারা ঘর ও জমি পেয়েছেন তাদের যে আনন্দ, তা আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’
তিনি জানান, এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মুজিব শতবর্ষে দেড় হাজার ভূমিহীন পরিবারকে ৪০ থেকে ৬০ শতক করে খাস কৃষি জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার কাজ চলছে। এরমধ্যে এক হাজার পরিবারকে বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়েছে।
নেত্রকোণার জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী
কার্যালয়ের আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী ভূমিহীন মানুষের মাঝে দেয়া হয়েছে ৯৬০টি সেমি পাকা বাড়ি, দ্বিতীয় ধাপে আরও ৯৬৫টি ঘর করে দেয়া হচ্ছে উপকারভোগীদের মাঝে। ঘরগুলো করার ক্ষেত্রে খুব সর্তকতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম হলে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ইউএইচ/
Leave a reply