শাকিল হাসান:
পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী রুপলাল হাউজের সামনে নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে রাজউক। যদিও ভবনটি নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিলো তারাই। জমির মালিকের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ এনে এখন নির্মাণ কাজ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে সংস্থাটি।
রুপলাল হাউজের ঠিক সামনের সাড়ে সাত দশমিক তিন সাত শতাংশ জমি ২০১২ সালে বিক্রি করেন ভবনটির একটি অংশের দাবিদাররা। নুরজাহান হাউজ নামে পরিচিত অংশটির মালিকরা ভবনটি পূর্বপাশের অংশে বসবাস করেন।
মালিকদের দু’জন মো. ফরহাদ এবং মো. রাজীবের দাবি, তাদের দাদী নুরজাহান বেগম রুপলাল হাউজের পূর্বপাশের অংশটুক কিনেছিলেন। ২০১০ সালে ভবনটির সামনে সাত দশমিক তিন সাত শতাংশের পেঁয়াজের একটি গুদাম ছিলো যেটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তারা। ২০১০ সালে জমির বায়না করা হয় আর ২০১২ সালে রেজিস্ট্রি করে দেয়া হয়। জমিটি কেনেন ফারইস্ট লাইফের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাসলিমা ইসলাম।
২০১৮ সালে সেখানে ভবন নির্মাণ করতে রাউজকে আবেদন করেন তাসলিমা। ভূমি ব্যবহার সম্পর্কিত সেই আবেদন ফরমে জমির পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আবেদনকারীকে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। সেখানে একটি প্রশ্ন ছিলো, জমির আশেপাশে আড়াইশ মিটারের মধ্যে কোন ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে কি না? আবেদনকারী সেখানে ‘না’ উত্তরে টিক দেন। অথচ এই জমির অবস্থান রুপলাল হাউজের আঙিনার মধ্যে। জমিতে ছয়তলা ভবনটি করা হলে রুপলাল ভবন থেকে সর্বোচ্চ দূরত্ব হবে আট-দশ ফুট। অথচ রাজউকের ইমারত বিধিমালায় আছে কোনো ঐতিহাসিক স্থাপনার আড়াইশ মিটারের মধ্যে কোনো স্থাপনা তৈরি করা যাবে না।
তাসলিমা ইসলামের এই আবেদনের প্রেক্ষিতে আটতলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় রাজউক। পরে জমির মালিকের সংশোধিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছয়তলার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় রাজউক। জমিকেনা ও ভবনের অনুমোদনের বিষয়ে কথা হয় তাসলিমা ইসলামের স্বামী ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, নুরজাহান হাউজের মালিকদের কাছ থেকে এক কোটি বিশ লাখ টাকায় স্ত্রীর নামে জমিটি কেনা হয়েছে। পরে আবেদন করা হলে রাজউক ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়।
এখনই ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা ছিলো না জানিয়ে নজরুল বলেন, রাজউকের আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে কাজ শুরু করতে হয়েছে। যদিও অনুমোদন পাওয়ার তিন বছর পর্যন্ত কাজ শুরু সময়সীমা দেয়া আছে রাজউকের ইমারত বিধিমালায়।
নজরুল দাবি করেন, সব ধরনের বিধি মেনেই আবেদন করা হয়েছে এবং রাজউকসহ অন্যান্য সংস্থা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে।
অনুমোদন পেয়েই লকডাউন চলার সময়েই নির্মাণ কাজ শুরু করেন জমির মালিক। স্থানীয় জনসাধারণ এবং প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ আন্দোলনকারীদের নজরে আসে বিষয়টি। তারা স্থানীয় সূত্রাপুর থানায় আপত্তি জানায়। ঈদের কয়েকদিন আগে পুলিশ এসে শ্রমিকদের নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে বলে। এর মধ্যে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। এসব খবর জানতে পেরে গত ২৩ মে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের দুই কর্মকর্তা সরেজমিনে নির্মাণস্থল পরিদর্শন করেন। তারা জানান, ঐতিহাসিক স্থাপনার পাশে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু, এই ভবনের অনুমোদনে রাজউক কোনো ছাড়পত্র নেয়নি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে না জানিয়ে রাজউক এখানে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিতে পারে না বলেও দাবি করেন অধিদফতরের দুই কর্মকর্তা।
একই দিন খানিক পরই নির্মাণ কাজ পরিদর্শনে আসেন রাজউকের দুই কর্মকর্তা। নির্মাণস্থলে ভবন নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্য সম্বলিত সাইন বোর্ড না থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন তারা। সেখানে থাকা নিরাপত্তা কর্মীদের নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় রাজউকের চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীর সঙ্গে। তিনি জানান, রুপলাল হাউজের জমিতে ভবন তৈরির বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে। এরই মধ্যে ভবনটির নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। তার দাবি, আবেদনকারী তথ্য গোপন করে রাজউক থেকে অনুমোদন নিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্তের আশ্বাস দিয়ে রাজউক চেয়ারম্যান জানান, রুপলাল হাউজের সামনে রাজউক কোনো ভবন করতে দেয়া হবে না।
রুপলাল হাউজের চারপাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অস্থায়ী টিনের স্থাপনা। সেখানে পেঁয়াজ, আদা, রসুনের আড়ত গড়ে উঠেছে। পুরো ফরাশগঞ্জ রোডেই মশলার ঝাঁঝালো গন্ধ আর ধুলাবালিতে টেকা দায়। প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ আন্দোলনকারীরা ভবনটি সংরক্ষণে দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছেন। রুপলাল ভবনের পুরোটাসহ আশেপাশের জায়গাও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণে নেয়া জরুরি বলে মনে করেন ঐতিহাসিক সংরক্ষণ আন্দোলনকারীরা।
Leave a reply