বাঙালির প্রতিটি গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে সূতিকাগারের মতো ভূমিকা রাখলেও উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে জাতিকে তেমন কিছু দিতে পারেনি শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর উদযাপন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টির গুনগত পরিবর্তন নিয়ে আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে নিজেদের প্রত্যাশার কথা জানালেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ।
স্বায়ত্তশাসন অটুট রেখে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তী কোনোকালেই শাসকদের কাছ থেকে সহায়তা না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তার মতে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষা ও সমাজ এই দুটি প্রেক্ষিত থেকে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। সূচনালগ্ন থেকেই শাসক শ্রেণীর সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন মনে করেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পেলেও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পায়নি। যে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির গুণগত শিক্ষা ও গবেষণায় ঋদ্ধ হওয়ার কথা, রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য না মেলায় তা আজও হয়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন শাসকদের রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ে করা হস্তক্ষেপ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করেছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতাপূর্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কমবেশি ভালোই ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষ করে পঁচাত্তরের পরে এক্ষেত্রে ধস নামে, যা এখনও চলমান।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নবযাত্রা শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যেন জ্ঞানচর্চার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হয়েছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ধ্বংস করছে বলে মনে করছেন ইতিহাসের বিখ্যাত এই অধ্যাপক। তিনি আরও বলেন, ঔপনিবেশিক আমলে, এমনকি পাকিস্তান আমলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ছিলেন জ্ঞান পাণ্ডিত্যে অগ্রণী ব্যক্তি। আর এখন তো পরিপূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ নিয়োগ দেয়া হয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে পাকিস্তান আমলের মতো সরকারের একেকটি বিভাগ মনে করা হয় এবং সেই হিসেবে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়।
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতের গৌরব এখন ঢাকা পড়েছে, এটাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। মুজিববর্ষে আমাদের অঙ্গীকার করতে হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার।
আর সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ পদ্ধতি রাজনীতিমুক্ত করতে হবে। উপাচার্য নিয়োগ হবে সার্চ কমিটির মাধ্যমে। সেই সার্চ কমিটি রাজনৈতিক বিবেচনায় হবে না। জ্ঞান-পাণ্ডিত্য, মেধা-মননের উপর ভিত্তি করে নিয়োগ করতে হবে উপাচার্য।
তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও এর বিকাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকার প্রশ্নকে খুব বড় করে দেখছেন না জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, জাতির প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছে।
আবার ঔপনিবেশিক আমলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ঘিরে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীতে নিচু ও ক্ষুদ্র স্বার্থের রাজনীতি করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান। তার মতে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি সবসময় ছিল। তবে একটা সময় সেই রাজনীতি ছিল বৃহত্তর স্বার্থে, দেশ ও জাতির জন্য ছিল সেই রাজনীতি। এখন ছাত্র-শিক্ষকরা ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে রাজনীতি করছে, দলীয় আধিপত্য বজায় রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি।
স্বাধীনতার আগে ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান তুলে ধরতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, জাতি গঠন, সমাজ পরিবর্তন ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ভূমিকা রেখেছিল স্বাধীনতার পর তা অনেকটাই কমে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা আগের মতো উদার মানসিকতা, সামাজিক উন্নয়ন, বৈষম্য, গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য আগে যে ভূমিকা রাখত, তা এখন অনেক কমে গেছে। আগের সে মানসিকতা আর নেই বিশ্ববিদ্যালয়টির।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শতাব্দীকে সামনে রেখে গবেষণার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে নানা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, দ্বিতীয় শতাব্দীতে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা এখন আমাদের মূল লক্ষ্য। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি শীর্ষক প্রতিপাদ্য ধারণ করে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সেই কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি এবং তা বাস্তবায়নে সকলের আন্তরিক সহায়তা প্রত্যাশা করছি।
Leave a reply