কেবল আক্রমণাত্মক নয়, ক্ল্যাসিক ডিফেন্সিভ ইতালিও গ্রাস করে নিচ্ছে জয়। রুদ্ধশ্বাস সেমিফাইনালে স্পেনকে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারিয়ে সেই প্রথম ম্যাচ থেকেই অপ্রতিরোধ্য চেহারার রবার্তো মানচিনির ইতালি দখল করলো ইউরো ফাইনালের টিকেট।
ওয়েম্বলিতে হলো দুই কোচের ট্যাকটিক্সের লড়াই। ইতালির পুরো টুর্নামেন্টে যে রকম আক্রমণাত্মক প্রেসিং ফুটবল খেলেছে তার সামনে স্পেন বলের দখল বেশি রাখার মাধ্যমে ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করার চিরাচরিত স্টাইল রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু রবার্তো মানচিনিকে অবাক করে প্রথমার্ধের বেশির ভাগ সময় ইতালিকে নিজেদের প্রান্তে ডিফেন্ড করতেই ব্যস্ত রেখেছে লুইস এনরিকের স্পেন। ফরোয়ার্ড পাসিং আর এন্ড টু এন্ড খেলায় টার্গেটে শট ও বলের দখল দুইই বেশি রেখেছে স্প্যানিশরা।
‘মোরাতা ও ১০ জন’ নিয়ে একাদশ সাজানোর নীতি থেকে এ ম্যাচে বেরিয়ে এসেছেন লুইস এনরিকে। মোরাতা ও আল্ভারো মরেনোর স্থলে ড্যানি অলমো ও অয়ারজাবালকে ফেরান তোরেসের সাথে রেখে সাজিয়েছেন আক্রমণভাগ। তাতে বেড়েছে আক্রমণের ধারও। তবে ড্যানি অলমো বেশ কয়েকটি সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে না পারায় প্রথমার্ধে এগিয়ে যেতে পারেনি স্পেন।
অন্যদিকে গত ম্যাচে দারুণ ফর্মে থাকা লেফট ব্যাক স্পিনাজ্জোলার ইনিজুরিতে বাধ্য হয়েই উইনিং কম্বিনেশন ভাঙতে হয় মানচিনিকে। এর সাথে তার তুরুপের তাস লরেঞ্জো ইনিসিনিয়াকে বোতল বন্দি করে রেখেছেন ম্যান সিটি ডিফেন্ডার আয়মেরিক লাপোর্তে। সার্জিও বুসকেটসের মাস্টারির সাথে তরুণ পেদ্রির নিখুঁত ও বুদ্ধিদীপ্ত পাসিং ও মুভমেন্টে মাঝমাঠের দখলও নিতে পারেনি ভেরাত্তি, জর্জিনিওরা। এবারের ইউরোতে তাই প্রথমবারের মতো দেখা গেল, বলের পেছনে ঘুরে সময় কাটছে কিয়েজা, ইম্মোবিলেদের।
স্পেন গোলরক্ষক উনাই সিমন ডি-বক্সের প্রান্তভাগে এসে দলকে বেশ কয়েকবার বিপদমুক্ত করলেও ড্যানি অলমোর ২৪ মিনিটে নেয়া শটটি সেইভ করে পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র দুটি গোল হজম করা ইতালিকে সেমিফাইনালে পিছিয়ে পড়া থেকে বাঁচিয়েছেন জিয়ানলুইজি ডোনারুমা। ইতালি এগিয়েও যায় বলতে গেলে ডোনারুমার হাত ধরেই।
সাধারণত এ দুটি দলই আক্রমণ রচনা করে নিচে থেকে। তবে ইতালিকে ডিফেন্ডিং ও কাউন্টার অ্যাটাকে খেলতে বাধ্য করে স্পেন। আর সেই পুরনো ধারায় ডোনারুমা সেইভ করা বল বাড়িয়ে দেন ইনিসিনিয়াকে। ইনসিনিয়া বল নিয়ে প্রায় পুরো অর্ধ এগিয়ে ডি-বক্সে ইম্মোবিলেকে বাড়ান পাস। ইম্মোবিলে বল হারালেও জুভেন্টাস উইঙ্গার কিয়েজা বক্সের বাম প্রান্তে বলের দখল নিয়ে এরিক গার্সিয়ার পাশ দিয়ে দুর্দান্ত এক বাঁকানো শটে পাল্টে দেন খেলার হিসাব। ইতালি এগিয়ে যায় ৬০ মিনিটে।
খেলার দারুণ গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ের পড়েই মানচিনি ও এনরিকে শুরু করেন তাদের বেঞ্চের সাহায্য নেয়া। গোল হজমের পর মুহূর্তেই ফেরান তোরেসের স্থলে নামেন আলভারো মোরাতা। নামানো হয় জেরার্ড মোরেনোকেও। অলআউট অ্যাটাকে না গিয়ে উপায় ছিল না এনরিকের। কিন্তু খেলার সময় শেষ হয়ে আসছিল আর তৈরি হচ্ছিল প্রশ্ন, ইউরোতে প্রথমবারের মতো আগ্রাসী আক্রমণাত্মক ফুটবল উপহার দিয়ে সে ম্যাচেই কি হারতে যাচ্ছে স্পেন?
জবাব দিতে তিনিই আসলেন, যার প্রমাণের বাকি ছিল অনেক। আলভারো মোরাতা আবারও দেখালেন, নিশ্চিত উপসংহারে পৌছানোর ঔদ্ধত্য ফুটবলের সাথে খাটে না। পুরো ম্যাচেই ইতালি ডিফেন্সকে ব্যস্ত রাখা ড্যানি অলমো মাঝমাঠে লাপোর্তের কাছ থেকে পেলেন এক ফরোয়ার্ড পাস। অলমোর সাথে ওয়ান-টু-ওয়ান করে আলভারো মোরাতা ফার্স্ট টাচে সরিয়ে দেন মার্কারকে। তারপর বাম পায়ের মাপা শটে ৮০ মিনিটে ঘোষণা দিলেন ওয়েম্বলিতে, লড়াইয়ে থাকবে স্পেন।
ম্যাচের ৭৪ মিনিটে ভেরাত্তিকে উঠিয়ে নেয়াটা হয়তো একটু আগেই হয়ে গেছিল। স্পেন ম্যাচে সমতা আনার পর ডিফেন্সের সাথে আক্রমণভাগের যোগসূত্র হচ্ছিল না আর। তাই লোকাতেল্লি, বেরার্দি, বেলোত্তি, পেসিনাদের নামিয়েও মাঠে আধিপত্য রচনা করতে পারেনি মানচিনির দল। তাই টাইব্রেকারে ডোনারুমাকে ঘিরেই ছিল যতো আশা। আর ইতালির চেয়ে গোলে দ্বিগুণ শট ও ৭০ শতাংশ বলের দখল রেখেও কিয়েল্লিনি, বোনুচ্চিদের দক্ষতায় নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটেও ব্যবধান গড়তে পারেনি লুই এনরিকের শিষ্যরা।
উনাই সিমনের কাছে লোকাতেল্লির ব্যর্থ হবার মাধ্যমে শুরু হয় টাইব্রেকার। মিস করেন ড্যানি অলমোও। ইতালির হয়ে বেলোত্তি, বোনুচ্চি, বার্নাদেস্কি ও শেষে জর্জিনিওর অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে ইতালি পৌছে গেল ইউরোর মহা আকাঙ্ক্ষিত ফাইনালে। আর টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস করে নিজ হাতে স্পেনের রঙ পাল্টানো ইউরো যাত্রার সমাপ্তি লিখে মোরাতা খুব দ্রুতই দেখে ফেললেন মুদ্রার অপর পিঠ। তাই দুর্দান্ত ফুটবল খেলার জন্য বেছে নেয়া দিনেই পরাজয় বরণ করে বাড়ির পথ ধরতে হচ্ছে স্প্যানিশদের। টানা দুটো ইউরো জয়ের পর টানা দুটো ইউরো থেকে বিদায়ের অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল জাভি, ইনিয়েস্তাদের পরবর্তী প্রজন্মের।
Leave a reply