রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে আনহেল ডি মারিয়া

|

শত আক্ষেপ ঘোচানো গোলের পর উল্লসিত আনহেল ডি মারিয়া। ছবি: সংগৃহীত

ঠিক ফাইনালের আগে, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পরম কাঙ্ক্ষিত ফাইনালের আগে, সকাল ১১টায় তৎকালীন ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এক চিঠি পান আর্জেন্টাইন উইঙ্গার আনহেল ডি মারিয়া। ইনজুরির কারণে সেমিফাইনাল মিস করা ডি মারিয়া মানসিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলেন ফাইনালের জন্য। পেইন কিলার খেয়ে খেলবেন, এমনটাই পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু সেই চিঠি পেয়েই এলোমেলো হয়ে গেল সব।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ডি মারিয়াকে যেন কোনোভাবেই খেলানো না হয় ফাইনালে। বাজারে তখন গুজব, রিয়াল মাদ্রিদ বিশ্বকাপের পর হামেস রদ্রিগেজকে সাইন করাতে যাচ্ছে। সে জন্য ডি মারিয়াকে বিক্রি করার চেষ্টা চালাবে মাদ্রিদ। বিক্রির পণ্যটাকে ওরা তাই নষ্ট করতে চাচ্ছে না। সহজ হিসেব। ফুটবল যে একটা ব্যবসা, সে দিকটা আমজনতা কখনো দেখতে পায় না। কিংবা দেখতে দেয়া হয় না।

অথচ ট্রেইনারের কাছে প্রকাশ করা ডি মারিয়ার মনোভাব ছিল, মাঠে যদি মরেও যান তিনি, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না ডি মারিয়ার। তিনি কেবল খেলতে চান।

হাতে পেয়েই কুঁচি কুঁচি করে ছিঁড়ে ফেললেন তিনি মাদ্রিদের চিঠিটা। পড়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি। ট্রেইনার ড্যানিয়েলকে বললেন, আজ সব সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার শুধুই আমার।

ফাইনালে সত্যি সত্যি খেলতে চেয়েছিলেন তিনি। তাতে যদি ক্যারিয়ার শেষও হয়ে যেতো, আপত্তি ছিল না। সেই সাথে দলের জন্যে কোন জটিল পরিস্থিতিও তৈরি করতে চাননি। তাই ম্যানেজারকে গিয়ে বললেন, তোমার যাকে খেলালে ভালো মনে হয়, তাকেই খেলাবে। যদি আমাকে বসাতে হয়, তাও সই। যদি অন্য কাউকে বসাতে হয় তাহলে সেই অন্য কেউই। আমি শুধু বিশ্বকাপটা জিততে চাই। আমাকে যদি নামাও, মরে যাবার আগ পর্যন্ত খেলবো।

অবশেষে আর আসেনি তার মাঠে নামার ডাক। হেরে গেলেন ম্যাচে। কোনোকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কাটলো জীবনের খুব কঠিন একটি রাত। ম্যাচ শেষে মিডিয়া ডি মারিয়ার না খেলা নিয়ে যা তা বলতে লাগলো। ভেঙে পড়লেন তিনি। ম্যানেজার আলেহান্দ্রো সাবেলার সামনে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। ভাবলেন হারিয়ে ফেলা মুহূর্তটা কত দামি, কত সাধনার! প্রায় অসম্ভব একটা স্বপ্নের কত কাছে তখন নীল-সাদারা।

সবাই বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখেছে, ফলটা দেখেছে। ০-১।

কত সম্ভব অসম্ভব যুদ্ধ জয় করে স্কোয়াডের কজন সে জায়গায় পৌঁছেছিলেন, কেউ কি তা জানে? লিভিং রুমের দেয়াল কি করে সাদা থেকে কালো হয়ে যায়, তা কি জানে কেউ? টিনের চালার নীচে ডি মারিয়ার বাবার দিনের পর দিন করে যাওয়া পরিশ্রমটা কেউ দেখেনি।

প্লেয়ারস ট্রিবিউনে আনহেল ডি মারিয়ার ‘In the Rain, in the Cold, in the Dark’ শিরোনামের আর্টিকেলে এসেছিল, ফুটবলারদের ঝাঁ চকচকে জীবনের প্রথম গল্পটা অনেকটাই একইরকম। সম্পূর্ণ গল্প পড়লে দেখা যায়, এটা একজন ল্যাটিন যোদ্ধার গল্প। হাতের নাগালে স্বপ্ন নিয়ে তা ছুঁয়ে দেখতে না পারার গল্প। এবং বারবার একই সাহসে একই স্বপ্ন দেখে যাওয়ার গল্প।

তবে মেসি, ডি মারিয়াদের এখন এসব আক্ষেপের সাথে কথা বলা বন্ধ। ডি মারিয়ার গোলে তারা জিতেছে দেশের হয়ে শিরোপা। চির প্রতিদ্বন্দ্বীর মাঠ থেকে জয় তুলে নিয়ে জবাব দিয়েছে ক্যারিয়ার জুড়ে নানা অবজ্ঞা আর গঞ্জনার। সেই সাথে, ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে ডি মারিয়ারা এখন সর্বজয়ী নায়ক। ফ্রান্সের বিপক্ষে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করে ডি মারিয়ার অশ্রুসজল চোখও বলে দেয়, কতটা কাঙ্ক্ষিত ছিল এই শিরোপা!

ডি মারিয়াদের এসব গল্প তাই পেল এক সুখী সমাপ্তি। হয়তো মনের কোণেই চাপা পড়ে যাবে একটি প্রশ্ন- রোদ,ঝড়, বৃষ্টিতে পুরোনো জংধরা সাইকেল গ্রেসিয়েলায় প্যাডেল চাপা ডি মারিয়ার মাকে কি আমরা কখনো দেখেছি, যিনি জীবনের দামে দেনা পরিশোধ করে ছোট্ট ফুটবল পাগল ডি মারিয়াকে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন, কিনে দিয়েছিলেন এক জোড়া বুট?

সবাই শেষমেশ ফলাফলটাই দেখবে। আর এবার সেখানে নায়কের নাম আনহেল ডি মারিয়া।

/এম ই


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply