নড়াইল প্রতিনিধি:
নড়াইলে অবস্থিত একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি সম্রাট বিজয় সরকারের বসতবাড়ি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। বাংলা কবিগানের অন্যতম প্রধান পুরুষ চারণ কবি বিজয় সরকার একাধারে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। এক হাজার ৮শ’র বেশি গান লিখেছেন তিনি। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।
নড়াইল সদর উপজেলার বাঁশগ্রাম ইউনিয়নের ডুমদি গ্রামে কবি বিজয় সরকারের বসতবাড়িতে নির্মিত বিজয় সরকার মঞ্চ, গ্রীন রুম এবং বিজয় চত্বর এখন গরু ও মাছের খাবার রাখার জায়গা এবং জ্বালানি ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও বিল পরিশোধ না করায় বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে সংযোগ। নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে নোংরা পরিবেশ বিরাজমান।
গত ৩৫ বছরেও সংরক্ষণ করা হয়নি চারণ কবি বিজয় সরকারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। এখানে বিজয় স্মৃতিসংগ্রহশালা নির্মাণের জন্য এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও তা পূরণ হয়নি এখনও। কবির বসতভিটা সদর উপজেলার বাঁশগ্রাম ইউনিয়নের ডুমদি গ্রামে যেতে এক কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা বেহাল।
গ্রামবাসী সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে নড়াইল জেলা পরিষদের অর্থায়নে প্রায় ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ডুমদি গ্রামে বিজয় মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। এখানে কবি যে ঘরে বসবাস করতেন সেখানে একটি টিনসেড ঘর এখনও রয়েছে। কিন্তু পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হচ্ছে ঘরে থাকা কবির ব্যবহৃত খাট, পাদুকা, পাঞ্জাবিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র।
কবির বসতভিটায় কবি পরিবারের কেউ না থাকায় গ্রামবাসীদের সহায়তায় এখানে ৬ বছর আগে ডুমদি গ্রামের বাসিন্দা বিমল সিকদার নামে এক ব্যক্তি দেখাশোনা করতে শুরু করলেও সে নিজেই মঞ্চ ও গ্রীন রুমে গরু ও মাছের খাবার রেখে ওই চত্বর নোংরা করছে বলে জানা গেছে।
নড়াইল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চিত্রাঙ্কন বিভাগের শিক্ষক নিখিল চন্দ্র দাস জানান, কিছু দিন আগে বিজয় সরকারের বাড়ি গিয়েছিলাম। দেখলাম কবি মঞ্চ, গ্রীন রুম এবং বসতবাড়ির আঙ্গিনা ময়লা আবর্জনায় ভরে গেছে। কিছু যুবক সেখানে গাঁজা সেবন করছে। নড়াইলের মুর্ছনা সংগীত নিকেতনের নৃত্যের শিক্ষক বিকাশ সিকদার জানান, গত শুক্রবার (৯জুলাই) বিজয় সরকারের বাড়িতে গিয়ে দেখি মঞ্চের ওপর বসে স্থানীয় এক ব্যক্তি গরুর খড় কাটছে। গ্রীন রুমে মাছের খাবার এবং জ্বালানী রাখা হয়েছে।
বাঁশগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ভবরঞ্জন রায় বলেন, গত ১৫ দিন আগেও বিজয় মঞ্চ ও গ্রীন রুম থেকে গরু ও মাছের খাবারসহ ওই এলাকা পরিস্কার করার ব্যবস্থা করেছিলাম। পরে আবার যা তাই। দুর-দুরান্ত থেকে প্রতিদিন এক থেকে দেড় শত বিজয়ভক্ত তার বাড়ি দেখতে আসেন। কিন্তু
গ্রামে আসার রাস্তা কাঁচা হওয়ায় বর্ষাকালে বিপাকে পড়েন দর্শনার্থীরা। ১ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা পাকাকরণের জন্য বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দেনদরবার করা হয়েছে। এছাড়া নড়াইল-২ আসনের সাবেক এমপি বিজয় সংগ্রহশালা নির্মানের জন্য ১৬ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছিলেন। তারপর আর কি হয়েছে তা বলতে পারবো না।
এ বিষয়ে নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, বিজয় মঞ্চ, গ্রীন রুম এবং বিজয় চত্বরের বেহাল অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আমার জানা নেই। তবে আমি খোঁজ নিয়ে দ্রুত এসব অপসারণের ব্যবস্থা নিচ্ছি। এছাড়া ১ কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণের বিষয়ে এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথেও কথা বলবো এবং বিজয় সংগ্রহশালা নির্মাণের প্রস্তাবনা কোন পর্যায়ে রয়েছে সে ব্যাপারেও খোঁজখবর নিচ্ছি।
উল্লেখ্য, বাংলা কবিগানের অন্যতম প্রধান পুরুষ চারণ কবি বিজয় সরকার। তিনি, পোষা পাখি উড়ে যাবে স্বজনী একদিন ভাবি নাই মনে, তুমি জাননা রে প্রিয় তুমি মোর জীবনের সাধনা, এ পৃথিবী যেমন আছে তেমনই ঠিক রবে, সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে, নবী নামের নৌকা গড় আল্লা নামের পাল খাটাও বিসমিল্লাহ বলিয়া মোমিন কুলের তরী খুলে দাও, জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কি- এ রকম অসংখ্য গানের স্রষ্টা।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুরস্রষ্টা কবিয়াল বিজয় সরকার ১৯০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নড়াইল সদরের নিভৃতপল্লী ডুমদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বার্ধ্যকজনিত কারণে ১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ভারতের হাওড়ার বেলুডে পরলোকগমন করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কেউটিয়ায় তাকে সমাহিত করা হয়।
Leave a reply