দুই দশক দীর্ঘ আফগান যুদ্ধের ইতি টানতে ২০১৯ সালে কাতারে অনুষ্ঠিত আমেরিকা-তালেবান শান্তি চুক্তির দেড় বছরের মাথায় আফগানিস্তান আবারও অশান্ত, সেখানে বাজছে গৃহযুদ্ধের দামামা। বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তানে তাদের সব সৈন্য প্রতাহার করে নেয়ার আগেই দেশটির প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ এখন তালেবানের হাতে।
গতকাল শনিবার (১৪ আগস্ট) পর্যন্ত তারা রাজধানী কাবুল থেকে মাত্র ৭০ কি.মি. দূরত্বে অবস্থান নিয়েছে বলে জানা গেছে। পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় কাবুলস্থ নিজ নিজ দূতাবাস থেকে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারিকে সরিয়ে নিচ্ছে আমেরিকা ও বৃটেন। গত মে মাসে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার শুরুর পর থেকেই তালেবানরা এত দ্রুত দেশটির বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নেবে তা ভাবনার বাইরে থাকলেও, এখন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপোর্ট বলছে, তালেবানের হাতে শিগগিরই পতন ঘটবে রাজধানী কাবুলেরও।
তবে পরিস্থিতির এমন আকস্মিক অবনতির পরও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বদলাচ্ছেন না ৪৬ তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। পেন্টাগন মুখপাত্র জন কিরবি নিশ্চিত করেছেন, কাবুলস্থ দূতাবাসের কর্মী প্রত্যাহারের কাজ সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা ৩১ আগস্টের মধ্যেই শেষ করতে চায় ওয়াশিংটন।
তালেবান সৃষ্ট গোলযোগের মধ্যেই আবারও আলোচনায় এসেছে দেড় বছর আগে হওয়া সেই শান্তি চুক্তি। কাতারের রাজধানী দোহায় ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল আফগান যুদ্ধের ইতি টানা। ঐতিহাসিক ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং তালেবান মুখপাত্র সোহাইল শাহীন৷
যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি না দিলেও চুক্তিতে তালেবানরা নিজেদেরকে ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। চুক্তির শিরোনামে ছিল– আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি। চুক্তিটির মূল ধারা ছিলো ৪টি-
১ম ধারায় বলা হয়, তালেবান নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে- আল-কায়েদাসহ সম ধরণের কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। তালেবান এ প্রতিশ্রুতির সর্বাত্ত্বক বাস্তবায়ন করবে।
২য় ধারায় যুক্তরাষ্ট্র এই মর্মে নিশ্চয়তা দেয় যে, আফগানিস্তান থেকে সকল বিদেশি সেনা প্রত্যাহার করা হবে, সেনা প্রত্যাহারের একটি সময়সূচি ঘোষণা পূর্বক এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সকল ব্যবস্থা তারা করবে।
৩য় ধারায় বলা হয়, প্রথম দুই ধারা বাস্তবায়নের পর তালেবানরা আফগানিস্তানের সরকারের সাথে আন্তঃআফগান আলোচনা ও সমঝোতার প্রক্রিয়া শুরু করবে। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এই আলোচনার তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২০২০ সালের ১০ মার্চ।
৪র্থ ধারায় বলা হয়, আন্তঃআফগান আলোচনায় আলোচ্যসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে উভয় পক্ষের অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হওয়ার ব্যাপারটি। আন্তঃআফগান আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা স্থায়ী ও সমন্বিত একটি অস্ত্রবিরতির তারিখ ও এর সম্ভাব্যতা নিয়ে শীঘ্রই আলোচনা করবেন। এবং এর বাস্তবায়নে যৌথ ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আফগানিস্তানের ভবিষ্যত রাজনৈতিক রূপরেখা ঘোষণার সময়ই অস্ত্রবিরতি ঘোষণাও দেয়া হবে।
চুক্তিটি এরপর তিনটি অংশে বিভক্ত হয়েছে। এই চুক্তির প্রথম দুটি ধারার বাস্তবায়নের ওপর পরের দুটি ধারার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে।
চুক্তিটির পরের তিনটি অংশের প্রথম অংশে ‘আমেরিকার করণীয়’ অংশে বলা হয়, চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকে পরের ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সকল বিদেশি সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
প্রথম অংশে মোট ছয়টি উপধারার উল্লেখ রয়েছে।
.
১ম উপধারায় বলা হয়, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এই চুক্তি ঘোষণার প্রথম ১৩৫ দিনের মধ্যে ৮ হাজার ৬০০ সেনা সরিয়ে নেবে। এবং একই সময়ের মধ্যে তারা আফগানিস্তানের ৫টি সেনাঘাঁটি থেকেও সেনা প্রত্যাহার করবে।
২য় উপধারায় বলা হয়, পরবর্তী সাড়ে ৯ মাসের মধ্যে বাকি বিদেশি সেনাদেরও প্রত্যাহার করতে হবে। এবং অন্যান্য সেনাঘাঁটিগুলো থেকেও
নিজেদের সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে।
৩য় উপধারায় বলা হয়, গত ২০ বছরে আমেরিকা কর্তৃক বন্দি ৫ হাজার তালেবান সদস্যকে মুক্তি দেবে তারা এবং এর বিনিময়ে তালেবান গোষ্ঠী তাদের জিম্মায় থাকা ১০০০ মার্কিনিকে মুক্তি দেবে।
৪র্থ উপধারায় বলা হয়, আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর পর আমেরিকা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে আরোপিত সকল নিষেধাজ্ঞাসহ যেসব তালেবান সদস্যকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিলো সে তালিকা পুনর্বিবেচনা করবে। ২০২০ সালের ২৭ অগাস্টের মধ্যে আমেরিকা তালেবানদের ওপর আরপিত সকল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার উদ্যোগ নেবে।
৫ম উপধারায় বলা হয়, আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর পর আমেরিকা তালেবানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কর্তৃক আরোপিত সকল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার প্রক্রিয়া আরম্ভের জন্য সদস্য দেশগুলোর সাথে আলোচনা শুরু করবে। এ কাজের জন্য সময়সীমা দেয়া হয় ২০২০ সালের ২৯ মে পর্যন্ত।
আর ৬ষ্ঠ উপধারাটি হল, আমেরিকা ও তার মিত্ররা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ যেকোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না এবং আফগানিস্তানকে বিভক্ত করতে হুমকি দেয়া বা বল প্রয়োগ থেকেও বিরত থাকবে।
চুক্তির দ্বিতীয় অংশে তালেবানের করণীয়গুলো উল্লেখ করা হয়, সেখানে বলা হয়, এই চুক্তির পাঁচটি দফা বাস্তবায়ন করবে তালেবানরা।
এর ১মটি হল, আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে নিজেদের কোনো সদস্য বা আল-কায়েদাসহ অন্য কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তি যাতে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করবে তালেবান।
২য় দফাটিও প্রায় একই ধরনের, সেখানে বলা হয় যে, আমেরিকা বা তার মিত্রদের জন্য হুমকি এমন সক্রিয় কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে সহযোগিতা করবেনা তালেবান।
৩য় দফাটি হল, আমেরিকা ও তার মিত্রদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি এমন কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তি যাতে সদস্য-তহবিল সংগ্রহ এবং তাদের প্রশিক্ষণের জন্য আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে না পারে সেটিও নিশ্চিত করবে তালেবান।
৪র্থ ও ৫ম দফায় যথাক্রমে শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিধি মেনে চলার অঙ্গীকার করেছে উভয়পক্ষ। আমেরিকা ও তার মিত্রদের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও ব্যক্তিকে ভিসা না দেয়া, অন্য কোনো ভ্রমণ অনুমতি না দেয়া বা অন্য কোনো আইনি নথি না দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তালেবান।
চুক্তিটির ৩য় অংশে আরও ৩টি দফা রয়েছে, যার ১মটিতে আমেরিকার পক্ষ থেকে এই চুক্তিটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অনুমোদনের চেষ্টার কথা বলা হয়েছে।
২য় দফায় বলা হয়, তালেবান ও আমেরিকা পরস্পরের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবে এবং নতুন পরিস্থিতিতে আন্তঃআফগান আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে একটি আফগান ইসলামিক সরকার গঠনের চেষ্টা করবে যা থেকে প্রতীয়মান হবে আন্তঃআফগান আলোচনা ইতিবাচক হয়েছে।
৩য় দফায় বলা হয়েছে, আন্তঃআফগান আলোচনার মাধ্যমে গঠিত আফগান ইসলামিক সরকারকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করার চেষ্টা করবে আমেরিকা এবং তারা আফগান সরকারের কোনো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।
উল্লেখ্য, আল-কায়েদা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলা চালানোর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আফগানিস্তানে অভিযান চালায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী। এ অভিযানেই তারা উৎখাত করে তৎকালীন তালেবান সরকারকে। প্রায় ২ দশকের এই যুদ্ধে প্রাণ হারানো আফগানদের সঠিক পরিসংখ্যান বের করাটা কঠিন। তবে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই যুদ্ধে ৩২ হাজারের বেশি বেসামরিক আফগান নাগরিক নিহত হয়েছেন।
আমেরিকা-তালেবানের আলোচিত এই শান্তি চুক্তি নির্ধারিত তারিখ থেকে কিছুটা দেরিতে হলেও গতবছরের ডিসেম্বরে এসেছিল প্রাথমিক চুক্তির খবর। কিন্তু তারপর দুই পক্ষের আলোচনায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এদিকে আলোচনা থমকে থাকলেও সংঘাত আর মৃত্যু থেমে নেই আফগানিস্তানে। কয়েক লাখ মানুষ ইতোমধ্যে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। গত কয়েক সপ্তাহে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৫০০।
এখন তালেবান এগিয়ে চলেছে রাজধানী কাবুলের দিকে, তাদের লক্ষ্য ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠা।
/এসএইচ
Leave a reply