স্টাফ রিপোর্টার, নেত্রকোণা :
পুরাতন টিনে মোড়ানো পরিত্যক্ত এক টয়লেটে শুয়ে আছেন বৃদ্ধ হতে চলা শংকরী। পায়ে শিকল। কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। খুব বেশি নড়াচড়ারও সুযোগ নেই। গত প্রায় ২০ বছর ধরে নিজ গৃহের পরিত্যক্ত টয়লেটে বাঁশের মাচার ওপর কাঠের তক্তা পেতে এভাবেই কাটছে মানসিক ভারসাম্যহীন শংকরীর জীবন। এভাবেই চলে খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, পয়ঃনিষ্কাশনসহ সবকিছু।
নেত্রকোনার দুর্গাপুর পৌর শহরের আমলাপাড়া মৃত শম্ভুলাল গুহের তৃতীয় সন্তান শংকরী লাল গুহ (৪৫)। স্বজনরা বলছেন, খুব মেধাবী ছিলেন শংকরী। দুর্গাপুর শহরের বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ালেখা করেছেন দীর্ঘদিন। পড়াশোনাকালীন বাবার মৃত্যুতে থমকে যায় পুরো পরিবার। বাবার চলে যাওয়ার শোক কাটিয়ে উঠে মামার বাড়িতে থেকে বেশ কয়েকদিন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও নবম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে পারেননি তিনি।
একসময় পড়়াশোনা ছেড়ে সংসারের কাজে মনোযোগ দেন শংকরী। ২০০১ সালে হঠাৎ করে একদিন নাকের সমস্যা দেখা দিলে কয়েকদিনের ব্যবধানে তা রূপ নেয় টিউমারে। পরিবারের সদস্যরা এর চিকিৎসা করে ভাল করলেও এরপর থেকে হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন হতে শুরু করে তার আচরণ। একপর্যায়ে, পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে শংকরী।
তখন থেকেই শুরু বন্দিজীবন। পায়ে কখনো মোটা রশি কিংবা শিকল বেঁধে স্বজনরা শুরু করে আটকে রাখার চেষ্টা। মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েকে কোনোরকম শান্ত রেখে সবসময় দেখাশোনা করতেন মা। ২০১৩ সালের শেষদিকে তিনিও পারি জমান পরপারে। পুরো সংসারের ভার এসে পড়ে ছোট ভাই জীবন লাল গুহের কাঁধে।
স্থানীয় একটি বেসরকারি প্যাথলজিতে পিয়নের চাকরি করে সংসার চললেও বোনের চিকিৎসার অর্থ মেলাতে পারেননি তিনি।
পুরো বাড়ি জুড়ে ভাঙাচোরা টিনের একটিমাত্র ঘর। ঘরের দুইটি কক্ষে গাদাগাদি করে থাকেন পাঁচ সদস্যের পরিবার। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না পেয়ে বাড়ির পেছনে পুকুর ঘাটের সঙ্গে পরিত্যক্ত টয়লেটের ওপর টিনের বেড়া দিয়ে তার ভেতর রাখেন মানসিক ভারসাম্যহীন বোনকে। এরপর থেকে টয়লেটের ভাঙা ঘরেই নিঃসঙ্গ জীবন কাটছে শংকরীর।
এখন আর কোনো স্মৃতি বা অনুভূতি নেই শংকরীর। সে যে মানুষ এটুকুও ভুলে গেছে। ডান পায়ের গোড়ালির ওপরে লোহার শিকল দিয়ে তালাবদ্ধ করা হয়েছে তাকে। আরেক পাশ বাঁধা টয়লেটের আরেকটি মোটা বাঁশের সঙ্গে। দীর্ঘদিনের এই বাঁধনে পায়ে দাগ পড়েছে, শিকলেও ধরেছে মরিচা।
স্থানীয়রা জানান, বছরের পর বছর ধরে আমরা শংকরীকে এভাবেই দেখছি। তাকে কখনোই বাইরে আসতে দেখা যায়নি। তার জন্য আমাদের অনেক কষ্ট হয়। তার ভাইও খুব গরিব মানুষ। আর্থিক সঙ্কটে বোনের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এখন যদি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারের পক্ষ থেকে কেউ এগিয়ে আসেন তাহলেই হয়তো শংকরী নতুন জীবনে ফিরতে পারে।
শংকরীর স্কুলজীবনের সহপাঠী শ্যামল রায় জানান, শংকরী অনেক মেধাবী ছাত্রী ছিল। হঠাৎ করেই কি যেন হয়ে গেলো। পরিবারের সদস্যরা অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন তবুও তাকে ভালো করতে পারেনি। ভাই সংসারের বোঝা টেনে নিয়ে আর চিকিৎসা করতে পারেননি। সে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছে।
শংকরীর ভাই জীবন লাল গুহ বলেন, হঠাৎ করেই আমার বোন অসুস্থ হয়ে গেছে। আমরা চিকিৎসা করিয়েছি। প্রায় ২০ বছরের বেশি হয়ে গেছে তার মানসিক সমস্যা। অনেক কষ্ট লাগে, কিন্তু কী করবো! আমার সামর্থ্য নেই। সামান্য একটা চাকরি করে কোনোরকমে সংসার চলে। নিজের ঘর ভেঙে পড়ছে। এখন তার জন্য একটা ঘর করে দেবো তারও কোনো সামর্থ্য নেই। টাকার সঙ্কটে চিকিৎসা করতে পারতেছি না।
দুর্গাপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিব উল আহসান বলেন, ওই নারীর অসুস্থতার বিষয়টি শুনেছি। আমি খুব দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবো। এছাড়া খবর পেয়ে খাবারের ব্যবস্থা করেছি। ঘরের জন্য টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
/এস এন
Leave a reply