সরকারি চাকরির জন্য নির্বাচিত হলে প্রার্থীর ডোপ টেস্ট বা মাদক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হচ্ছে। আর এ পরীক্ষার ফল নেতিবাচক হলে চাকরির জন্য অযোগ্য হবেন প্রার্থী। তবে সরকারি এ সিদ্ধান্তে উদ্বিগ্ন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটির মতে, এতে মাদকাসক্তরা সারাজীবন পরিবার তথা সমাজের বোঝা হয়ে থাকবেন। ফলে এরা আরও ভয়ঙ্কর ও উচ্ছৃঙ্খল হবেন। এমন শঙ্কা ব্যক্ত করে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ে কাজ করা ও সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতার সুবাদে এই চিঠি দেয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরে। মূলত তারাই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। চিঠিতে জেলায় জেলায় মাদক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে বলেও জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার।’
৪ ফেব্রুয়ারি লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘মাদকাসক্ত একটি রোগ, যা চিকিৎসায় ভালো হয়। দেশের বিপুল সংখ্যক মাদকাসক্ত রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেয়ার পরিস্থিতি দেশে নেই। চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হওয়ার পর এদের সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ দিলে তারা ভালো হওয়ার জন্য উৎসাহ বোধ করবেন। আর যদি চাকরির ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, তবে তারা সারাজীবন পরিবার তথা সমাজের বোঝা হয়ে থাকবেন। ফলে আরও ভয়ঙ্কর ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠবেন। মাদকাসক্তের পরিবার তথা সমাজকে এর দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে। তাদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না করে এ ধরনের কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া সঠিক হবে না।’
এই বিষয়ে আইজিপির দেয়া দুটি প্রস্তাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, ‘দেশের সব জেলায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের আওতায় একটি করে আধুনিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করা দরকার। আপাতত সব জেলা সদর হাসপাতালে বা ১০০ শয্যার বেশি হাসপাতালগুলোতে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র খুলতে হবে। এরপর পেশা ও বৃত্তির জন্য বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। পরীক্ষায় নেতিবাচক ফল পাওয়া গেলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বিদেশ গমনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। পাশাপাশি ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে অনুরূপ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এছাড়া সরকারি, স্বায়ত্ত্বশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কেউ মাদকাসক্ত হলে তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।’
জানা গেছে, পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কমচারীদের কেউ মাদক সেবন করেন এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় গত নভেম্বরে মাদক পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে ইতিমধ্যে জনপ্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, ‘ দেশে বর্তমানে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যেও মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে ও কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তাই ডোপ টেস্টের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করলে যুবসমাজের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।’
বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে জানান, কিছুদিন আগে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) নিয়োগের সময় সন্দেহ হওয়ায় ডোপ টেস্ট করার পর ১৮ জনকে মাদকাসক্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়। সরকারি আরও কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি ভয়ঙ্কর। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে। নিয়োগের সময় এ পরীক্ষা করলে শিক্ষার্থীরা সচেতন হবে, ভীতি তৈরি হবে।
পুলিশ অধিদফতর সূত্র জানায়, মাদক ব্যবসায় ও মাদক সেবনের অভিযোগে গত এক বছরে পুলিশের শতাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ছয় মাসেই কেবল ৬৭ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশ পরিদর্শক পদের সদস্যরাই মাদক ব্যবসা এবং মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া এএসপি থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন পর্যায়েও কিছু কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাদক সেবন, মাদক ব্যবসায় সহায়তা এবং মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এটি শুধু পুলিশ বাহিনীর সমস্যা নয়। জনপ্রশাসন, চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশায়ও এ সমস্যা দিন দিন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মাদক সেবন ও বিক্রির বিষয়টি উঠে এসেছে। এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক চিকিৎসক নিয়মিত মাদক গ্রহণ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে দেয়া এক প্রতিবেদনে চিকিৎসকদের মাদকাসক্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে। বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সর্বশেষ বৈঠকেও ব্যাপক আলোচনা হয়। এ বিষয়ে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বিষয়টিও সংবাদ সম্মেলনে জানান দেন কমিটির সভাপতি ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। (প্রতিবেদন: দৈনিক যুগান্তর)।
Leave a reply