মুহাম্মদ আরিফুর রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ফেনী:
ফেনীর পরশুরামে নির্বাচন মানেই যেন ‘বিনাভোটে নির্বাচিত’ হওয়ার ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট হয়নি। বিজয়ী প্রত্যেকেই ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন ভোট ছাড়াই। তাদের সকলেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত।
অভিযোগ উঠেছে, এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপরীতে যিনিই মনোনয়ন সংগ্রহ করছেন, তিনিই হামলা বা মারধরের শিকার হচ্ছেন। বিগত সময়ে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও এবার আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ নিজেই। হামলা শিকারও হচ্ছেন তারাই ।
চলতি বছরের (২০২১) ১৪ ফেব্রুয়ারি পরশুরাম পৌরসভার নির্বাচন হওয়ার দিন ধার্য ছিল। তার আগে মেয়র, কাউন্সিলর, মহিলা কাউন্সিলর সকলেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। একই পৌরসভায় এর আগে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে মেয়র, কাউন্সিলর, মহিলা কাউন্সিলর সকলেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এমনকি ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরশুরাম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানও বিনাভোটে নির্বাচিত।
২০১৬ সালের মার্চে নির্ধারিত হয় পরশুরাম উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন পরিষদের (বক্সমাহমুদ, মির্জানগর ও চিথলিয়া) নির্বাচনের তারিখ। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারায় সে নির্বাচন স্থগিত করে দেয় নির্বাচন কমিশন। পরবর্তীতে একই বছরের ৩১ অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সকল প্রার্থী বিনাভোটেই নির্বাচিত হন।
এবার তৃতীয় ধাপে পরশুরাম উপজেলার তিনটি (বক্সমাহমুদ, মির্জানগর ও চিথলিয়া) ইউনিয়নে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহও করেছেন। পুরনো অবস্থার ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। এখনো মনোনয়নপত্র জমা দেননি অন্য কোনো প্রার্থী। এরই মধ্যে অভিযোগ, খোদ নিজ দলের কর্মীদের দ্বারাই হেনস্থার শিকার হচ্ছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ব্যতীত অন্য প্রার্থীরা। হামলা-ভাঙচুরসহ জোর করে মনোনয়ন পত্র ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগও রয়েছে।
২৪ অক্টোবর রাতে বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাকির হোসেন অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবদুল গফুরের বিপরীতে প্রার্থী হওয়ায় তার বাড়িঘরে হামলা ও মনোনয়নপত্র ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জাকির হোসেন বাদী হয়ে মো. জনি (২৫)-কে প্রধান আসামি করে ৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো ১০-১৫ জনের বিরুদ্ধে পরশুরাম থানায় ২৪ অক্টোবর রাতেই একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজহারে বলা হচ্ছে, রোববার (২৪ অক্টোবর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে মনোনয়নপত্র নিয়ে স্ত্রীসহ বাড়িতে যাচ্ছিলেন তিনি। এসময় গুথুমা তাজুলের বাড়ির সামনে আসলে জনি, রনি, ইয়াছিনসহ ১৫/২০জন তার সিএনজি গতিরোধ করে তাকে মারধর করে। কিছুক্ষণ পর রাতে তার বাড়িতে গিয়ে অভিযুক্তরা হামলা চালায় ও বসতঘর ভাঙচুর করে।
জাকির গতবছর আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেলেও এবার পাননি। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন। এ ঘটনার জন্য তিনি পরশুরাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সাজেলকে দায়ী করেছেন। তিনি পরশুরাম পৌরসভার মেয়র, যিনি নিজেও কিনা বিনাভোটে নির্বাচিত।
ঘটনার ২৪ ঘণ্টা না যেতেই জাকির হোসেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল গফুরের পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন। এ বিষয়ে জাকিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কিচ্ছু বলতে চাই না। সাংবাদিকরা আপনারা বুঝে নেন।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও আওয়ামী লীগের এক কর্মী জানান, জাকির ভাই জীবন বাঁচানোর তাগিদে ওদের সাথে হাত মিলিয়েছেন। তাকে অব্যাহতভাবে জীবননাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে।
এই বিষয়ে আবদুল গফুর বলেন, আমরা ভাই ভাই এক। আমাদের মধ্যে কোনো হিংসা বিরোধ নেই। ওইদিনের ঘটনা সামান্য ভুল বোঝাবুঝি।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে পরশুরাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সাজেলকে মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে ২৩ অক্টোবর মির্জানগর ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ফেনী জেলা যুবলীগের সদস্য ফখরুল ইসলাম ফারুকও অভিযোগ করেন তার বাড়িতে হামলার। তিনি বলেন, মির্জানগর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পদের আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে দলটির ধানমণ্ডির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ২৩ অক্টোবর মানববন্ধন করছিলাম। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান ভুট্টোর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও করি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা আমার বাড়িতে হামলা করে। আমি বর্তমানে এলাকাছাড়া।
একই সময় অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী এমরান হোসেনের কাছ থেকেও চেয়ারম্যান প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে ভুট্টোর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এ সম্পর্কে নুরুজ্জমান ভুট্টোর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমি এসবের কিছুই জানি না।
একইভাবে চিথলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুর রহমান মিলনকে বর্তমান চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিনের আপন ভাই মো ইউছুফ ও ফারুক ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন ‘ভুক্তভোগী’ নিজে। অবশ্য তিনি এখনই নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়াবেন না বলে জানিয়েছেন।
পরশুরাম থানার অফিসার ইনচার্জ খালেদ হোসেন জানান, একজন স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর উপর হামলার ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। অভিযুক্তদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। আর নির্বাচনকে সামনে রেখে সকল প্রার্থীকে সমান নিরাপত্তা দেয়া হবে। আমাদের কাছে অভিযোগ আসলে আমরা সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
তৃতীয় ধাপে দেশের ১ হাজার ৭টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৮ নভেম্বর। ১৪ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন সভায় অনুমোদনের পর এ ধাপের ভোটের তফসিল ঘোষণা করেন ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ২ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। মনোনয়নপত্র বাছাই ৪ নভেম্বর ও প্রত্যাহারের শেষ সময় ১১ নভেম্বর। ভোট গ্রহণ হবে ২৮ নভেম্বর।
Leave a reply