মানুষের জীবন যাত্রায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এখন আর কেউ সূর্য দেখে সময় নির্ধারণ করে না, এখন কূপের পানি কেউ পান করে না, মাটির হাড়িতে রান্না কেউ করে না। যোগাযোগ রক্ষা করতে চিঠি আদান-প্রদানের ওপর নির্ভর করতে হয় না। সবকিছুতে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া ও প্রযুক্তির ছোঁয়া। যা প্রতিটি মানুষের লাইফস্টাইলকে স্বপ্নের মতো বদলে দিয়েছে। কিন্তু বিগত চল্লিশ বছরেও কোনো পরিবর্তন আসেনি সুফিয়া বেগমের জীবনে, চল্লিশ বছর ধরে ঘানিতে আটকে আছে তার জীবন ।
টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার জোত আতাউল্লাহ ব্যাপারি বাড়িতে সুফিয়া বেগমের বসবাস, বয়স আনুমানিক পঞ্চান্ন, ছোট বেলা থেকেই ঘানি ঘুরানো আওয়াজের সাথে তার বেড়ে ওঠা, কারণ সেকালে সুফিয়া বেগমের বাবার বাড়িতেও ঘুরতো তেলের ঘানি, তার বাবাও পেশায় তেল বিক্রেতা ছিল, সেসুবাদে ব্যাপারি বাড়ির মেয়ে সুফিয়া বেগম বাবার সাথেও ঘানি ঘুরানোর কাজে সহযোগিতা করত সে।
সুফিয়া বেগম চল্লিশ বছর আগে জোত আতাউল্লাহ গ্রামের ব্যাপারি বাড়ির ছেলে রজব আলীর বউ হয়ে আসে। স্বামীর বাড়ি এসে সংসারের হাল ধরতে এখানেও ঘানি টানা শুরু করতে হয় নববধূ সুফিয়াকে। চল্লিশ বছর ধরে টানা বুকের মাঝে চেপে ঘানি ঘুড়াতে হচ্ছে তাকে। সুফিয়া বেগম ও রজব আলীর সংসারে তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়েছে, এক ছেলে পোশাক কারখানায় কর্মরত আরেক ছেলের বউ নিয়ে আলাদা সংসার। স্বামী রজব আলী নয় মাস আগে, অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে শ্বাসকষ্ট (এজমা) রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
তাই ঘানি ঘুরানো উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল সে। ঘানি থেকে তেল বানাতে ঘানির ওপর দেড় মণ ওজনের বড় পাথর তুলে দিতে হয় এবং তা বুকের সাথে লেপ্টে ঘুরতে হয় সারাদিন। ছেলে মেয়ে কেউ তাকে দেখাশোনা করে না, অভাবের সংসারে দুবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার জন্য এই কাজ করছেন।
মেশিন বা গরু কিনে এইকাজ করার সামর্থ্য তার নেই। চল্লিশ বছর ধরে ঘানি টানায় রাতে বুকের ব্যথায় ঘুমাতে পারেনন না। দৈনিক পনেরো কেজির মতো সরিষা থেকে চার/পাঁচ কেজি তেল বানানো সম্ভব হয়, পাঁচ কেজি সরিষা ভাঙ্গিয়ে ১২০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়। এ হিসাবে তাদের দৈনিক ৩৬০টাকা ইনকাম হয়।
প্রথম দিকে দুই জন মিলে এই কাজ করলেও, এখন তিনজন দরকার হয়। বাকি দুইজন পার্শ্ববর্তী বাড়ির মহিলাকে সহযোগিতার জন্য নিতে হয়, তিন জনে ভাগ করে নেন মজুরির টাকা। একাধিক এনজিও কর্মী এসেছে, আশ্বাস দিলেও কোনো সহযোগিতাই মেলেনি তার ভাগ্যে। ঘানি টানতে কোনোভাবেই তার শরীর উপযোগী নয়, ঘানি ঘুরানোর জন্য এক জোড়া ষাড় বা বলদ গরু পেলে অমানবিক কষ্ট থেকে মুক্তি মিলবে এখন তার।
এলাকাবাসীরা বলেন, সুফিয়া বেগমের এরকম অমানবিক কাজ দেখলে খুব কষ্ট লাগে, যদি সরকার থেকে তাকে সহযোগিতা করা হয় তাহলে ভাল হবে।
উপজেলা সহকারী সমাজসেবা অফিসার মনজুরুর রহমান বলেন, এ বছর কোনো বরাদ্ধ নেই ,সামনে কোনো বরাদ্ধ আসলে অবশ্যই তিনি পাবেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ মল্লিক বলেন, বিষয়টি আমি জানিনা। সত্যি খুব অমানবিক ঘটনা এটা। আমি অতি শিগগিরই ব্যবস্থা নেবো।
Leave a reply