মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসা আলেয়া বেগম যৌতুকের বলি হয়ে নিজ জেলা সিরাজগঞ্জ থেকে আসেন রাজশাহীতে। পরে আবারও সংসার শুরু করেন। বর্তমানে বৃদ্ধ মা, অসুস্থ স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে থাকেন নগরীর হেতেম খাঁ এলাকায় ভাড়া বাড়িতে। তবে স্বজনের সংখ্যা তার অগণিত। যাদের কেউ নেই, তাদের স্বজন হয়েই আছেন আলেয়া।
কেউ বা বিকারগ্রস্ত কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন। কারো শরীর বা হাত-পায়ের অংশ পঁচা। কারো শরীরে ধরেছে পোকা। চরম সংকটময় পরিস্থিতিতেও পাশে নেই তাদের স্বজন। এমন অসুস্থ অভিভাবকহীন মানুষদের সেবা করাকেই একমাত্র ব্রত হিসেবে নিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মী আলেয়া বেগম। গত ১৩ বছর ধরে নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিয়ে শত শত দুঃখী অসুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন এ শ্রমজীবী নারী।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ড এর বাইরে পাশাপশি অনেকগুলো বেডে চিকিৎসা চলে ভারসাম্যহীন, বেওয়ারিশ রোগীদের। তাদের বিলাপ, আহাজারিতে অনেক সময়ই বিরক্ত হন অন্যান্য সেবাপ্রত্যাশীরা। এমনকি, অনেক সময় তাদের এড়িয়ে যান দায়িত্বরতরাও। তবে ব্যতিক্রম আলেয়া বেগম। হাসপাতালের দৈনিক মজুরিভিত্তিক এই কর্মীর কাজ পরিবার পরিজনহীন রোগীদের সেবা দেয়া। আর সেই কাজ করতে করতে এক সময় তা পরিণত হয়েছে নেশায়। ১৩ বছর ধরে হাসপাতালে আসা এমন শত শত রোগীকে আলেয়া দিয়ে যাচ্ছেন সেবা।
আলেয়ার ব্যাপারে একজন সেবিকা জানান, তিনি অনেক সময় রোগীদের মুখে তুলেও খাইয়ে দেন। আমাদেরও প্রায়ই সংকোচ হয়। কিন্তু এমনটা হয় না আলেয়ার। তিনি বুঝতেই দেন না যে এইসব রোগীদের আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। মা-বোন হয়েই তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এই আলেয়া।
আলেয়ার এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে হাস্যরস করেন অনেকে। কেউ কেউ বলেন কটু কথাও। কিন্তু নিজের মন যা বলে, তাই করে চলেছেন আলেয়া। নিজের সামান্য উপার্জন পুরোটা খরচ করেন রোগীদের জন্য। কখনও চেয়ে-চিন্তে টাকা এনেও করেন সহায়তা। আলেয়া বেগম বলেন, আমি হাসপাতালে ঢুকি সকাল ৮টায়, আর বের হই রাত ১১টা/সাড়ে ১১টায়। আমার ডিউটি ১টায় শেষ। বাকি সময় এই রোগীদের দেই।
দিন রাত খেটে রোগীদের সুস্থ করে তুলতে পারলেই আলেয়ার মুখে হাসি ফোটে। চিকিৎসার পর অনেককেই পৌঁছে দিয়েছেন আপন নীড়ে। নিজের বাড়িতেও স্থান দিয়েছেন এক প্রতিবন্ধী ছেলেকে। মানুষের সেবায় এতোটাই ব্যস্ত থাকেন আলেয়া যে, ঈদের দিনও পারেন না পরিবারকে সময় দিতে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, রোগীদের সেবা তো আলেয়া করেই। এর সাথে রোগী যখন সুস্থ হয়ে ওঠে, আলেয়া জিজ্ঞেস করে জেনে নেন তাদের ঠিকানা কোথায় বা আত্মীয়-স্বজন কেউ আছেন কিনা। তারপর আমাদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে সিএনজিতে করে পৌঁছেও দেয় সে।
আলেয়া বেগম বলেন, রোগীরা ছুটি নিয়ে চলে যায়। কিন্তু তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। এরপর তাদের আমি কীভাবে খাওয়াবো। আমি তো গরিব মানুষ। তাদের খাবার, পোশাক আরও অনেক কিছুই লাগে। আমি এসব সামলাতে পারছি না। বেশ বিপদে আছি। তাছাড়া হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে এই রোগীরা।
তাই আলেয়ার মতে, স্বজনহীন এসব রোগীর জন্য আলাদা ইউনিট থাকলে আরও ভালোভাবে সেবা দিতে পারতেন তিনি।
Leave a reply