গল্পরা আঁকিবুকি করছে প্রতিটি চোখে। শরীরের একেকটি অঙ্গ সাক্ষ্য দিচ্ছে একেকটি ঘটনার। ভয়, ক্লান্তি, বিষাদ, অবসাদ, জখম এবং অবশেষে সীমান্ত পাড়ি দিতে পেরে প্রাণে বেঁচে যাওয়ার এক নিশ্চিন্ত অনুভূতি। একটি আত্মা যেন বয়ে বেড়াচ্ছে একটি করে উপন্যাসের উপজীব্য। এত এত গল্পের মাঝে কোনটি বর্ণনার জন্য বাছাই করা যায়? কোন আশ্রয়প্রার্থীর গল্পটি বলা বেশি দরকার? কোন ঘটনাটি সবচেয়ে করুণ? উখিয়া-টেকনাফে গত কয়েকদিন কাটানো কোনো সাংবাদিকদের পক্ষে এসব প্রশ্নে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার উপায় নেই। প্রতিটি গল্পই করুণ। প্রতিটি ঘটনাই মর্মস্পর্শী। প্রতিটি অভিজ্ঞতাই চোখ ভেজানো।
এমন হাজারো ঘটনার মধ্য থেকে কয়েকটি ঘটনা সংক্ষেপে জানাচ্ছেন কদরুদ্দীন শিশির-
‘তুমিই দিয়া দেও আমার নাতিনটার একটা নাম’
৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে কুতুপালংয়ে নেমেছি মাত্র। চারদিকে হাজারো নারী-শিশু-বৃদ্ধ। কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবো তার কথা শোনার জন্য। ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলাম ডক্টটর্স উইদাউট বর্ডারের চিকিৎসা শিবিরের দিকে। ক্যাম্পের সামনেই একটি খাবারের দোকান। সেটির বারান্দায় দেখলাম শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। হাতে তার ব্যান্ডেজ। সেদিকে এগুতেই বৃদ্ধ এক মহিলা বললেন, ‘গুলি লাগিছে’। সীমান্ত পাড়ি দেয়ার আগে মিয়ানমারের সেনারা বিভিন্ন পয়েন্টে পলাতক মানুষের ওপর দূর থেকে এলোপাতাড়ি গুলে ছুঁড়েছে। সেগুলো লেগেছে কারো হাতে, কারো পয়ে। পেটে-পিঠেও লেগেছে কারো কারো। শুয়ে থাকা সত্তোর্ধ্ব আলী আকবরের লেগেছিল হাতে। কৃশকায় শরীর। হাঁটতে পারেন না। এসেছেন গ্রামের এক যুবকের কাঁধে সওয়ার হয়ে। গুলি লাগার পর এপারে আসতে আসতে রক্ত গেছে প্রচুর। ক্যাম্পের ডাক্তাররা শত রোগীর ভিড়ে একটা স্যালাইন দিয়ে শুইয়ে রেখেছেন দোকানের বারান্দায়। পাশের বাড়ির মানুষ, তাই তাকে এখানে ফেলে কোথাও খাবার সংগ্রহের জন্য যেতে পারছেন না বৃদ্ধা সাজেদা বেগম। লোকটা একটু পর পর পানি চাচ্ছিলেন। রাস্তা ধারে পড়ে থেকে ফলের জুস, কিম্বা গরম দুধ তো আর চাইতে পারেন না তিনি! সাজেদা বেগম তাই পানিই দিচ্ছিলেন চামচে করে।
সাজেদার পাশে বসা এক মেয়ে। তার কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা। মুখ বাদে পুরোটা একটা ন্যাকড়ায় ঢাকা। ‘উনি কে?’ জিজ্ঞেস করতেই সাজেদা মুখে হাসি এনে বললেন, ‘আমার পোলার বউ। নাম লতিফা। কোলেরটা নাতনি আমার। এখানে আসার পর গত পরশুর আগের দিন হইছে।’ অল্প বয়সি মেয়েটির কোলে তার বাচ্চা! এবং এই বাচ্চাটিকে পেটে বহন করে তিন/চারদিনের রাস্তা হেঁটে এসেছে সে!
বেশ অনেকক্ষণ কথা হলো। আসার গল্প শোনালেন কাঁদতে কাঁদতে। ওখানকার জীবন-সংসারের কথা জানালেন হেসে হেসেই। ছেলে-নাতিদের প্রসঙ্গ এলে মুখ উজ্জল হয়ে ওঠে সাজেদার। ‘নাতনির নাম কী রাখলেন?’ প্রশ্ন করতেই বললেন, ‘কিছু রাখি নাই তো। কী রাখবো? তুমিই একটা নাম রেখে দাও বাবা!’
আমার একটু কেমন লাগলো বোধহয়! এত অল্প সময়ের পরিচয়-কথাবার্তা। এর মধ্যে তাদের একটা পারিবারিক বিষয়ে আমি জড়িত হবো! ‘না থাক। আপনারা রেখে দিয়েন একটা।’ বুড়িমা বোধহয় একটু মন খারাপ করলেন। ‘ভালবেসে’ অচেনা এক ছেলেকে হাসিমুখে বলেছিলেন নাতনির নাম রেখে দিতে। কিন্তু ছেলেটা গুরুত্ব দিল না। কয়েক মুহূর্ত ভেবে ঠিক করলাম, দিয়েই যাই একটা নাম। বার্মায় তারা ফিরে গেলে কোনো একদিন ভাবতে ভালো লাগবো সে দেশের একটি মেয়ের নাম আমি রেখেছিলাম! মেয়ের মা-খালা-ফুফুদের নাম জেনে নিলাম তাদের রাখা নামের ধরন সম্পর্কে ধারণা পেতে। তারপর বললাম, ‘রাশেদা’! রাশেদা বেগম। খুশি হয়ে মুচকি হাসলেন বুড়িমা। ‘বাবা, আমাদের একটু সাহায্যের ব্যবস্থা করে দিও। তিনদিন এখানে আছি। কেউ কিছু দিলে খাই। না দিলে বইসা থাকি।’
আলী আকবর আর বেঁচে নেই
৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে আবার ঘুরতে ঘুরতে কুতুপালংয়ের সেই দোকানের বারান্দায় হাজির। কী ব্যাপার হাতে গুলিবিদ্ধ সত্তোর্ধ্ব আলী আকবর কোথায়? নিশ্চয় চিকিৎসা ক্যাম্পের ভেতরে নিয়েছে বোধহয়, অবস্থা বেগতিক দেখে। এগিয়ে যেতেই সাজেদা বেগম বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার কাছে আরো ৫/৬ জন মহিলা। সবাই বোরকা পরা। কারো কোলে বাচ্চা। ‘কেমন আছেন’ বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে আবারও জিজ্ঞেস করলাম ‘এখানে যিনি ছিলেন, উনি কই?’। মুখ বেজার করে জানালেন, সকাল ৭টায় মারা গেছেন আলী আকবর। লাশ দাফনের জন্য নিয়ে গেছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। ক্যাম্পে থাকা কর্তৃপক্ষীয় লোকজন গত ক’দিনে এভাবে কয়জন মারা গেছেন তার নির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারলেন না। জানালেন, কয়েকজন মারা গেছেন, তবে সংখ্যার হিসাব তারা রাখছেন না। কয়েকশো মিটার দূরে রাস্তার পাশে একটি খুঁড়োখুঁড়ি চলা জায়গা দেখিয়ে রোহিঙ্গা এক ছেলে বললো, গত দুই সপ্তাহে নানাভাবে মারা যাওয়া ১৮ জনকে সেখানে কবর দেয়া হয়েছে।
‘নিজেরে ছোটলোক মনে হইতেছে, স্যার!’
নূরের বয়স ২২ বছর। এই বয়সেই বউ-বাচ্চা আছে। মংডু, বুচিডঙে ট্রাক চালাতেন, সব সময় মুখে মিষ্টিহাসি লেগে থাকা এই যুবক। কয়েক বছর অন্যের গাড়ি চালানোর পর গত বছর নিজেই একটা কিনেছিলেন- বাংলাদেশি ১২ লাখের মতো টাকা দিয়ে। ঈদুল আজহার আগে বাজারে তার ট্রাকটি পুড়িয়ে দিয়েছে মগরা- এমনটাই জানালেন নূর। এরপর ঈদের দিন বাংলাদেশে ঢুকেন। গত এক সপ্তাহে কোনো দিন একবেলা ভাত জুটেছে। কখনো সারাদিনে একবার বিস্কুট খেয়ে পার হয়েছে। ‘আজ দুপুরে খেয়েছেন?’ প্রশ্নের জবাবে আরাকানি টানেই বললেন, ‘এলাকায় আমরা বড়লোক আছিলাম। কোনো দিন গাড়ি চালিয়ে ২০ হাজার টাকাও পাইতাম। এখানে এসে নিজেরে ছোটলোক মনে হইতেছে, স্যার।’ ‘টাকা’ বললেও বার্মার মুদ্রার কথাই বুঝিয়েছেন নূর। ‘দুপুরে খেয়েছেন কিনা- উত্তর তো দিলেন না!’ তখন নূরের জবাব, ‘না স্যার খাইনি। বাচ্চাটা তার মায়ের দুধ খায়। আর আমরা এখনো খাওয়ার কিছু পাইনি।’ মোবাইলে তাকিয়ে দেখলাম তখন সন্ধ্যা ৭টার কিছু কম।
(চলবে…)
কদরুদ্দীন শিশির : সাংবাদিক
Leave a reply