বিমান, রেল, বাস প্রতিটি দুর্ঘটনায় বেঁচে গেছেন; জিতেছেন কোটি টাকার লটারিও

|

ফ্রানে সেলাক। ছবি: সংগৃহীত

লাক সিনেমা যারা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয় মনে আছে সঞ্জয় দত্ত কতটা মিরাকল ব্যক্তি ছিলেন। সবসময় ভাগ্য প্রসন্ন ছিল সঞ্জয় দত্তের। যে কোনো দুর্ঘটনায়ই রক্ষা পেয়েছিলেন এই বলিউড অভিনেতা। বাস্তব জীবনে এই গল্পকেও হার মানিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার ফ্রানে সেলাক।

ভারতের সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ফ্রানে সেলাকের কানের ধার ঘেঁষেই বোধহয় মৃত্যুদূতের যাতায়াত। কিন্তু প্রতিবারই মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবলীলায় জীবনে ফিরেছেন। যা তাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘সৌভাগ্যবান দুর্ভাগা’ হিসেবে খ্যাতি এনে দিয়েছে।

ফ্রানে পেশায় সঙ্গীত শিক্ষক। শারীরিকভাবে তিনি যে দারুণ চাঙ্গা, এমনটাও নয়। এই ফ্রানে নিজের জীবনে সাতবার বড় রকমের জীবন সঙ্কটে পড়েছেন। বিমান দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে গাড়ি বিস্ফোরণ, ট্রেন দুর্ঘটনা— কিছুই বাদ নেই তালিকায়। কিন্তু দুর্ঘটনা যত বড়ই হোক সামান্য কাটা ছেঁড়ার উপর দিয়েই ফ্রানের বিপদ কেটেছে।

ফ্রানেকে ‘সৌভাগ্যবান দুর্ভাগা’ বলার দু’টি কারণ— সৌভাগ্য এই কারণে, প্রতিবারই তিনি নিশ্চিত মৃত্যুকে এড়িয়ে যেতে পেরেছেন। আর কপাল খারাপের কারণ, কয়েকবার তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে।

ক্রোয়েশিয়াতেই ফ্রানের জন্ম ১৯২৯ সালের ১৪ জুন। এখন তিনি ৯২ বছরের বৃদ্ধ। তবে মৃত্যুর সঙ্গে তার পাঞ্জা শুরু সেই ১৯৬২ সালে। তখন তার বয়স ৩২।

প্রথম ঘটনাটি ঘটে ওই বছরের জানুয়ারি মাসে। কনকনে ঠান্ডায় ক্রোয়েশিয়ার এক শহর থেকে অন্য শহরে সফর করছিলেন যুবক ফ্রানে। যে ট্রেনে তিনি উঠেছিলেন সেটি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়। বেলাইন হয়ে নদীতে পড়ে যায় ট্রেনের বেশ কয়েকটি কামরা। ঠান্ডায় নদীর বরফ জলে ডুবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মারা যান ফ্রানের ১৭ জন সহযাত্রী। ফ্রানেও ডুবে গিয়েছিলেন। কিন্তু মোক্ষম সময়ে কেউ নদীর জল থেকে টেনে তুলে আনে তাকে।

হাত ভেঙে গিয়েছিল। তীব্র ঠান্ডায় হাইপারথেমিয়াতেও আক্রান্ত হন ফ্রানে। তবে প্রাণে বেঁচে যান। অবশ্য এই ঘটনা তার ঘটনাবহুল জীবনের একটা ছোট্ট উদাহরণ। ফ্রানে তখন জানতেনও না, তার জীবনের ‘কান ঘেঁষা মৃত্যু’ সিরিজের সবে প্রথম পর্ব এই ঘটনা।

পরের ঘটনাটি ঘটে পরের বছরই। ট্রেনে চড়া তখন কমিয়ে দিয়েছেন ফ্রানে। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে বিমানে উঠেছিলেন। আসন সংরক্ষণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপরও কেবিন সদস্যদের পাশে বসে সফর করার অনুমতি আদায় করে ফেলেছিলেন ফ্রানে। বিমান যখন মাঝ আকাশে তখন কাজ করা বন্ধ করে দেয় দুটো ইঞ্জিন। ফ্রানে দরজার কাছে বসেছিলেন। কেবিনে বায়ুর চাপ কমে যেতেই দরজা ভেঙে বেরিয়ে যায়। প্লেন থেকে ছিটকে যান ফ্রানেও। ওই ঘটনায় বিমানের ভেতরে থাকা বাকি ১৯ জন মারা গিয়েছিলেন।

এদিকে ফ্রানে, যিনি প্যারাশ্যুট ছাড়াই বিমান থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন, বেঁচে যান। তিনি নিজে অবশ্য ভেবেছিলেন আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সব শেষ। কিন্তু আকাশ থেকে তিনি সোজা গিয়ে পড়েন একটি খড়ের গাদায়। তেমন কোনও আঘাতই পাননি ফ্রানে!

ঠিক এই পর্যন্ত পড়ে যদি মনে হয় এর থেকে বেশি আর কী ঘটতে পারে, তবে বলতে হবে এখনও অনেক জানার বাকি। সবে তো জমজমাট সিরিজের এটি দ্বিতীয় পর্ব।

বাস দুর্ঘটনায় রক্ষা পান ফ্রানে সেলাক

তৃতীয় ঘটনা ঘটে বিমান দুর্ঘটনার তিন বছর পর ১৯৬৬ সালে। বাসে সফর করছিলেন ফ্রানে। চাকা খুলে বাসটি নদীতে ডুবে যায়। যাত্রী অল্পই ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৪ জন ডুবে মারা যান। সৌভাগ্যবশত ফ্রানে সাঁতার জানতেন। তিনি সাঁতরে পাড়ে ওঠেন। সেবারও তিনি বিশেষ কোনো আঘাত পাননি।

এই ঘটনার পর ট্রেন, বাস, বিমানে সফর বন্ধ করে দেন ফ্রানে। ঠিক করেন যেখানে যাবেন নিজের গাড়িতেই যাবেন। কিন্তু সেখানেও বিপদ। ১৯৭০ সালে ফ্রানে যখন গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তার গাড়িতে আগুন ধরে যায়। চলন্ত গাড়ি থেকেই ঝাঁপ দেন ফ্রানে। মুহূর্তের মধ্যে গাড়ির জ্বালানির ট্যাঙ্কে বিস্ফোরণ হয়। তার চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় গাড়িটি।

১৯৭৩ সালে আবার গাড়ি দুর্ঘটনার মুখোমুখি হন ফ্রানে। এবার অবশ্য বিস্ফোরণ নয়। ফ্রানের গাড়ির জ্বালানি পাম্প ভেঙে ইঞ্জিন থেকে আগুনের হলকা বার হতে শুরু করে। আগুনের হলকায় ফ্রানের মাথার চুল পুড়ে যায়। সামান্য উচ্চতার হেরফেরে তার শরীরটাও পুড়ে যেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। আবারও কান ঘেঁষে বেরিয়ে যায় মৃত্যু।

১৯৯৫ সালে রাস্তায় হাঁটছিলেন ফ্রানে। একটি বাস তাকে সজোরে ধাক্কা মারে। ছিটকে নরম বালিতে গিয়ে পড়েন। বেঁচে যান ফ্রানে।

১৯৯৬ সালে তার গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা লাগে রাষ্ট্রের একটি ট্রাকের। পাহাড়ি রাস্তায় ৩০০ মিটার গড়িয়ে পড়ে ফ্রানের গাড়ি। তবে গাড়ির ভিতর ফ্রানে ছিলেন না। গাড়িটি খাদে পড়ার মুহূর্তে ছিটকে একটি গাছের ডালে আটকে যান তিনি।

ফ্র্যানের জীবনে এখন পর্যন্ত অবশ্য এটাই শেষ দুর্ঘটনা। তবে এত কিছুর পর ২০০৩ সালে ফ্রানে লটারি জেতেন। যখন তার বয়স ৭৩।

বুড়ো বয়সে জেতেন কোটি টাকার লটারি

১১ লক্ষ ১০ হাজার ডলার জিতেছিলেন লটারিতে। এক দিনে কোটিপতি। লটারির টাকায় দু’টি বিরাট বাড়ি আর একটি বিলাসবহুল নৌকা কিনেছিলেন ফ্রানে।

তবে ২০১০ সালে তিনি হঠাৎই ঠিক করেন তার জেতা লটারির অধিকাংশ টাকা এবং তা থেকে কেনা সম্পত্তি আত্মীয় বন্ধুদের বিলিয়ে দেবেন। তারপর থেকে একান্তে অতি সাধারণভাবে জীবন কাটাতে শুরু করেন ফ্রানে। সম্ভবত মৃত্যুকে বারবার কাছ থেকে দেখে জীবনের আসল মানে খুঁজে পেয়েছেন তিনি।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply