হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিতে বিজয়ের সকালের গল্প

|

ছবি: সংগৃহীত

বিজয়ের মুহূর্ত নিয়ে কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্পে’ লিখেছেন মুক্তির আনন্দের স্মৃতি। তবে সেই স্মৃতিতে কেবল যে আনন্দই ছিল তা নয়। সেই স্মৃতিকথায় ছিল যুগপৎ হাসি ও কান্নার গল্প। স্বাধীনতার আনন্দে তখন মানুষ হাসছে। আবার আপনজন হারানোর বেদনায় উৎসারিত কান্নার স্রোতে সেই হাসির ভেসে যাওয়াও ছিল সেই স্মৃতিতে। ছিল জনতার দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে স্বাধীন দেশকে প্রথমবারের মতো প্রাণভরে দেখার এক অনির্বচনীয় আনন্দ, যেন কান্নাভেজা চোখে ফুটতে দেখা এক অনিন্দ্য সুন্দর কার্পাস ফুল।

হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘…তখন ঝিকাতলায় থাকতাম। আমার সাথে ঝিকাতলায় সেই একতলা টিনের ছাদের বাড়িতে ছিলেন আমার অতি প্রিয় বন্ধু আনিস সাবেত। তিনি বয়সে আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। ১৬ ডিসেম্বর আমরা দু’জন কী করলাম একটু বলি।

হঠাৎ মনে হলো আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পৃথিবী উলট-পালট হয়ে গেছে। সারাক্ষণ কানে ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ হচ্ছে। আনিস সাবেত বাড়ির সামনের মাঠে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। তিনি শব্দ করে কাঁদছেন। গড়াগড়ি করছেন। আমি তাকে টেনে তুললাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চল রাস্তায় চল। একটু আগেই তিনি কাঁদছিলেন। এখন আবার হাসছেন। আমরা রাস্তায় নেমে পড়লাম এবং ফাঁকা রাস্তায় কোনো কারণ ছাড়াই দৌড়াতে শুরু করলাম। আনিস ভাই এক হাতে শক্ত করে আমাকে ধরে আছেন, আমরা দৌড়াচ্ছি। ঢাকা শহরের সব মানুষ ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে। যার যা ইচ্ছা করছে। চিৎকার, হইচই, লাফালাফি, মাঝে মধ্যেই আকাশ কাঁপিয়ে সমবেত গর্জন ‘জয়বাংলা’। প্রতিটি বাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ছে। এই পতাকা সবাই এত দিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল কে জানে?

কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

ঝিকাতলার মোড়ে আমাদের দু’জনকে লোকজন আটকাল। তারা শঙ্কিত গলায় বলেন, রাস্তা পার হবেন না। খবরদার! কিছু আটকে পড়া বিহারি দোতলার জানালা থেকে ওই দিকে গুলি করছে। আমরা গুলির শব্দ শুনলাম। আনিস ভাই বললেন, দুত্তেরি গুলি! হুমায়ূন চল তো! আমরা গুলির ভেতর দিয়ে চলে এলাম। আমাদের দেখাদেখি অন্যরাও আসতে শুরু করল।

সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে এসে আনিস ভাই দুই প্যাকেট বিস্কুট কিনলেন (আমার হাত সে সময় শূন্য, কেনাকাটা যা করার আনিস ভাই করতেন)। আমরা সারাদিন কিছু খাইনি। প্রচণ্ড ক্ষিদে লেগেছে। আমি আনিস ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, আনিস ভাই, পোলাও খেতে ইচ্ছা করছে। তিনি বললেন, অবশ্যই পোলাও খাবো; পোলাও! আমরা দু’জন অর্ধউন্মাদের মতো ‘পোলাও পোলাও’ বলে চেঁচালাম। রাস্তার লোকজন আমাদের দেখছে। কেউ কিছু মনে করছে না। একটা রিকশাকে আসতে দেখলাম। রিকশার সিটের উপর বিপজ্জনক ভঙ্গিতে মধ্যবয়স্ক এক লোক দাঁড়িয়ে। তিনি জিগিরের ভঙ্গিতে বলেই যাচ্ছেন ‘জয় বাংলা। জয় বাংলা। জয় বাংলা।’ আনিস ভাই তার হাতের বিস্কুটের প্যাকেট গুঁড়া করে ফেললেন। আমিও করলাম। আমরা বিস্কুটের গুঁড়া ছড়িয়ে দিতে দিতে এগোচ্ছি। কোন দিকে যাচ্ছি, তাও জানি না। আজ আমাদের কোনো গন্তব্য নেই।’

তথ্যসূত্র: হুমায়ূন আহমেদ, জোছনা ও জননীর গল্প



সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply