‘এপ্রিল ফুল’ এর উৎপত্তি ও ইতিহাস নিয়ে এক কথায় কিছু বলার সুযোগ নেই। কবে কিভাবে দিনটি উদযাপন শুরু হয় পশ্চিমা বিশ্বে, তার সর্বজন স্বীকৃত কোন তথ্য বা তত্ত্ব নেই। দেশে দেশে অনেক অনেক গল্প আছে ‘এপ্রিল ফুল’ নিয়ে। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব না। আমরা এখানে ভিন্ন একটি ঘটনা তুলে ধরবো। আজ থেকে ৪১ বছর আগে ‘এপ্রিল ফুল’ পালন করতে গিয়ে বিশ্বকে কিভাবে বোকা বানিয়েছিলো ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান- সেই ঘটনা।
১৯৭৭ সালের ১ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এর পাঠকরা পত্রিকা হাতে পেয়ে চমকে ওঠেন। আজ নাকি একটি দেশের ১০ম স্বাধীনতা দিবস, অথচ সেই দেশের নাম জীবনে কেউ শোনেনি! আবার সেই দেশকে নিয়ে ৭ পাতার বিশেষ ‘ক্রোড়পত্র’ প্রকাশ করেছে ‘দ্য গার্ডিয়ান’। এলাহি কাণ্ড। কিন্তু কেউ তো কখনো নামই শুনলো না ‘স্যান শেরিফ’ নামক দেশটির!
পাঠক তো বিস্মিত, হতবাক। কিন্তু ‘দ্য গার্ডিয়ান’কে তো আর অবিশ্বাস করা যায় না। নামকরা একটি পত্রিকা। কোনো দেশ না থাকলে নিশ্চয়ই এতবড় আয়োজন করে তা প্রচার করবে না। অতএব সবাই নিজেদের ‘অজ্ঞতা’ই স্বীকার করে নিলেন। নিশ্চয়ই ‘স্যান শেরিফ’ নামে ভারত মহাসাগরে একটি দ্বীপদেশ আছে!
এরপর শুরু হলো ফোন করার পালা। আরও বিস্তারিত জানতে চান পাঠকরা। আর জানতে চাইবেই না কেন! ‘স্যান শেরিফ’ এর যেসব মনোমুগ্ধকর স্বর্গীয় পরিবেশের বর্ণনা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ফিচার রিপোর্টে তাতেই দ্বীপটিতে ভ্রমণের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেছেন শৌখিন মানুষজন!
পরে পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষ জানায়, ওইদিন তারা ফোনের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। এবং মানুষের মধ্যে এত সাড়া দেখে বিস্মিতও হয়েছিলেন তারা। পাঠকের বিশ্বাস এমন পর্যায়ে গিয়েছিলো যে, পত্রিকার সম্পাদক পিটার প্রেসটনের কাছে ব্রিটিশ বিভিন্ন এয়ারলাইন্স ও বিভিন্ন পর্যটন বিষয়ক কোম্পানি লিখিত অভিযোগ জানায়, ‘স্যান শেরিফ’ নামে যে কোনো দেশ বাস্তবে নেই তা তাদের গ্রাহকদেরকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করাতে পারছেন না। গ্রাহকরা যেকোনোভাবেই হোক ‘স্যান শেরিফ’-এ বেড়াতে যেতে চান!
৭ পৃষ্ঠার বিশেষ ক্রোড়পত্রের ৪ পৃষ্ঠাই ছিলো বিজ্ঞাপন। মূলত এই বিশাল বিজ্ঞাপনের লোভেই এমনভাবে ‘এপ্রিল ফুল’ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো দ্য গার্ডিয়ান। অবশ্য বিজ্ঞপানগুলিও লেখা হয়েছিলো ফিচারাইজড ভঙ্গিতে। অনেক পাঠক জানিয়েছিলেন, তাদের কাছে বিজ্ঞাপনগুলোই বেশি আকর্ষণীয় ঠেকেছিলো।
এত বিশাল আয়োজন করে পাঠকদেরকে বোকা বানানোর ধারণাটি প্রথম আসে পত্রিকাটির ‘স্পেশাল রিপোর্ট’ বিভাগের দায়িত্বে থাকা ফিলিপ ডেভিসের মাথায়। তিনি অন্যান্য বিভাগের সম্পাদকদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে সবাই এক কথায় রাজি হয়ে যান। এরপর একটি টিম বেশ কয়েকদিন পরিশ্রম করে ‘স্যান শেরিফ’ এর কল্পিত মানচিত্র, অবস্থান, জনসংখ্যা, ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে নানা ‘তথ্যবহুল’ ও ফিচারাইজড লেখা তৈরি করেন।
মোটামুটি সিরিয়াস ভঙ্গিতে লেখা হলেও মাঝে মাঝে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয় যাতে কিছুটা খটকা লাগে। দ্বীপদেশটির সাথে সংশ্লিষ্ট নানা নামের ক্ষেত্রে প্রিন্টিং জগতের বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল। যেমন দেশের নাম ‘স্যান শেরিফ’ মূলত একটি ইংরেজি ফন্টের নাম! এভাবে প্রকাশনা জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা শব্দ ব্যবহার করা হয় নাম হিসেবে।
রিপোর্টে লেখা হয়, এর অবস্থান ভারত সাগরের সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের উত্তর পূর্ব দিকে। পঞ্চদশ শতক থেকে স্যান শেরিফ দ্বীপপুঞ্জটি স্প্যানিশ ও পর্তুগীজদের উপনিবেশ ছিলো। সপ্তদশ শতাব্দীতে এটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে যুক্ত হয়। দুশ বছরের পরাধীনতা শেষে ১৯৬৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে স্যান শেরিফ। এরপর দেশটির শাসন করেন একনায়ক কর্নেল হিসপালিস ও জেনারেল মিনিয়ন। ১৯৭১ সালের ১১ মে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে দেশটির ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল পিকা।
প্রথমে কিন্তু এটির অবস্থান লেখা হয়েছিল আটলান্টিক মহাসাগরে। কিন্তু রিপোর্ট প্রকাশের মাত্র ৩ দিন আগে ২৭ মার্চ আটলান্টিকের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি এলাকায় দু’টি বিমানের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫৮৩ জন মানুষ নিহত হন। এমন হৃদয় বিদারক ঘটনার পর একই এলাকার কোনো কল্পিত দ্বীপ নিয়ে তামাশা করাটা পাঠকরা হালকাভাবে নাও নিতে পারে। এজন্য দুর্ঘটনার পরপরই ‘স্যান শেরিফ’কে আটলান্টিক থেকে ভারত মহাসাগরে স্থানান্তর করে গার্ডিয়ান কর্তৃপক্ষ।
পাঠককে অত্যন্ত সফলতার সাথে বোকা বানানোর এই ধারা ব্রিটিশ পত্রিকাগুলো অনুসরণ করতে শুরু করে। পরের কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পত্রিকা নানাভাবে তাদের পাঠকদেরকে ‘এপ্রিল ফুল’ উপলক্ষে বোকা বানানোর জন্য নানা আয়োজন করতে থাকে। তবে গার্ডিয়ানের মতো এত বিশাল পরিসরে কোনো আয়োজন কেউ কখনো করেনি।
Leave a reply