একটি ভুুল তথ্য বা সংবাদ কতটা ক্ষতিকর হতে পারে?

|

একটি ভুল তথ্য ১৪ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। এখনও প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে। আজও হয়তো এক বা একাধিক আদম সন্তান জীবন দিয়ে মাশুল গুনছেন সেই ভুল তথ্যের। একটি দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। বহু দেশ ভুগছে তার কুফল। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জটিল সমস্যার উদ্ভবও ঘটেছে সেই ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নেয়া পদক্ষেপের ফলশ্রুতিতে। ইরাকে পশ্চিমা জোটের হামলার কথা বলা হচ্ছে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার দেশটিতে হামলা করেন যে অজুহাতে, সেটি ছিল একটি ভুল বা মিথ্যা তথ্য। এই দুই নেতা এবং তাদের সরকার দাবি করেছিল, ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ (Weapon of mass destruction) রয়েছে।

তাদের এই দাবিকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে তখন কোমর বেঁধে নামে পশ্চিমা মিডিয়া। আমেরিকার এবং বিশ্বের সাধারণ মানুষের মনে গেঁথে দেয়া হয়, হ্যাঁ সাদ্দাম খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছেন। তাকে থামাতেই হবে। নয়তো দুনিয়ায় না-জানি কোন মহাধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে ফেলেন এই লোক!

এরপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। শত শত বিমান দিয়ে বোমা মেরে ১০ বছর ধরে হত্যা করা হয় ১৪ লাখের বেশি ইরাকীকে। আহত, পঙ্গু, উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের সংখ্যা নিরূপন করতে না যাওয়াই ভাল। গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়া হয় দেশটিতে বাস করা বিভিন্ন জাতি-উপজাতির মধ্যে।

পশ্চিমা রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এখন বলেন, ইরাক হামলার ফলই হচ্ছে আজকের ভয়ঙ্কর জঙ্গিগোষ্ঠি আইএসের উত্থান। এই জঙ্গি সংগঠনটি বিশ্বজুড়ে উগ্রপন্থায় নতুন মাত্রা যোগ করে।

শুরুতেই বলেছি, এসবই হচ্ছে একটি ভ্রান্ত তথ্যের ওপর নির্ভর করে নেয়া ভুল পদক্ষেপের ফল। কিছুদিন আগে টনি ব্লেয়ার নিজেও কথাটি স্বীকার করেছেন। যদি তখন বুশ ও ব্লেয়ার প্রশাসন ও তাদের স্বার্থের ভাগিদার পশ্চিমা মিডিয়ার সেই ভুল প্রচারণাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতো, তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দিত যে, ইরাকে গণবিধ্বংসী কোনো অস্ত্র নেই, তাহলে হয়তোবা হামলার অজুহাত খঁজে পেতে কষ্ট হতো যুদ্ধবাজ পশ্চিমা নেতাদের। ধ্বংসের মুখোমুখি হওয়া থেকে বেঁচে যেত একটি জাতি।

তথ্যই শক্তি- এটি প্রমাণিত সত্য। যার কাছে সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে সঠিক এবং সবচেয়ে তাৎক্ষণিক তথ্য আছে সেই বর্তমান দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় ক্ষমতাবান-শক্তিশালী। আবার উল্টোটাও আছে। ভুল তথ্যকে সঠিকের মতো করে প্রচার করেও কেউ ক্ষমতাবান হয়ে উঠে। একই সাথে তা কারো জন্য হয়ে উঠে ধ্বংসের কারণ। যার ভয়াবহতম উদাহরণ হচ্ছে ইরাক।

প্রাত্যহিক জীবনে ভুল তথ্যের কারণে ছোট-বড় ক্ষতির মধ্যে পড়ার শঙ্কা আছে। ভুল তথ্যের কারণে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কেউ ফতুর হয়ে যেতে পারেন। রাজনীতিবিদদের অনেকেই প্রতিদিন ভুল ও মিথ্যা বার্তা দিয়ে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে থাকেন। সংবাদমাধ্যম ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে আমাদের বোকা বানায়। ভুল তথ্য দেয়া বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করে ঠকার কথা তো আমরা বুঝতেও পারি না। ধর্মীয় নেতার ভুল ব্যাখ্যায় হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে অমানুষ হয়ে উঠছে কিছু যুবক। লেখক-ইতিহাসবিদরা ভুল তথ্য, বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার ঘটনাও আমাদের কাছে খুবই পরিচিত। এভাবে মিথ্যা, ভুল, বিকৃতি ও বিভ্রান্তি প্রতিনিয়ত আমাদের কেমন ক্ষতি করছে তা আমরা একটু খেয়াল করলেই অনুমান করতে পারবো।

এমতাবস্থায় সারাবিশ্বেই ‘ফ্যাক্ট-চেকিং’ বলে একটি পরিভাষা বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এখন আর কোনো ‘বড় লোক’, ‘সম্মানিত ব্যক্তি’ বা প্রতিষ্ঠানের কথা বা বক্তব্যকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা হচ্ছে না। বেশ আগে থেকেই ফ্যাক্ট চেকিং পশ্চিমা দুনিয়ায় পেশাদারিত্বের সাথে চললেও বিগত কয়েক বছর ধরে এর চর্চা দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে বিগত মার্কিন নিবার্চনকে কেন্দ্র করে রক্ষণশীল ও উদারবাদী রাজনীতিক এবং মিডিয়ার মধ্যে চলা লড়াইয়ে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের বিষয়টি বেশ আলোচনায় আসে।

বলা হয়ে থাকে, অবলীলায় মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে উপস্থাপনের বিশেষ দক্ষতা আছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের। আবার তার বিরোধীরাও যে মিথ্যা বলেন না, বা বিভ্রান্তি ছড়ান না তেমনটি নয়। ফ্যাক্ট চেকাররা এসব ধরিয়ে দেন।

কোনো ইস্যুতে আসল তথ্যটি কী- তা জানার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে। কিন্তু মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয় বিধায় তারা অনেক সময় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বে সঠিক তথ্যটি তুলে ধরতে পারে না। আবার হয়তোবা কেউ তার আদর্শিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে জেনে বুঝেই এড়িয়ে যান সত্যকে। অন্যান্য সীমাবদ্ধতাও আছে সংবাদকর্মীদের। খুবই সীমিত সময়ের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই একটি ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য সবগুলো পক্ষ ও সূত্র যাচাই করে সংবাদ তৈরি করা সম্ভব হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিকভাবে প্রকৃত সত্যটা মার খেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

এ জন্য প্রয়োজন এমন কিছু সংস্থা বা ব্যক্তির যারা পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করবেন নিরাসক্তভাবে। দেখার চেষ্টা করবেন ঘটনার সবগুলো দিক। ঘাঁটবেন একটি প্রচারিত তথ্যের বিপরীতে কী প্রামাণ্য তথ্য আছে। তারপর সত্যের কোনো বিচ্যুতি ধরা পড়লে তা তুলে ধরবেন গ্রহণযোগ্য প্রমাণ সহকারে। এই কাজটিকেই ফ্যাক্ট চেকিং বলা হচ্ছে। যাবতীয় পক্ষপাত ও পছন্দ-অপছন্দের উর্ধ্বে থেকে ফ্যাক্ট চেকারদের কাজ হচ্ছে, ফ্যাক্ট বা বাস্তবটা খুঁজে বেড়ানো। এবং ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতার সাথে নব্য প্রচারিত তথ্য বা বক্তব্যের গরমিল পেলেই তা মানুষকে জানানো।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিউক রিপোর্টার্স ল্যাব এর তথ্য মতে, বিশ্বের ৪৪টি দেশে বর্তমানে ১১৪টি ফ্যাক্ট চেকিং টিম কাজ করছে। ৪৩টি ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার অধীনে এসব টিম পরিচালিত হয়। আমেরিকা এবং ইউরোপে ইতোমধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বড় কোনো কোম্পানি বা মিডিয়া হাউজের সাথে সংশ্লিষ্টতা না এসব সংস্থা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে কাজ করে থাকেন ফ্যাক্ট চেকাররা।

আবার ব্যক্তিগত উদ্যোগও আছে। জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনা করে গত বছর গুগল তার নিউজ ফিডে ফ্যাক্ট চেকিং ফিচার যোগ করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটগুলোর ফ্যাক্ট চেকিংয়ের জন্য আলাদা অ্যাপস বানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট। ২০০৯ সালে মর্যাদাপূর্ণ পুলিৎজার পুরস্কার পায় ‘ফ্যাক্ট চেক’ এবং ‘পলিটি ফ্যাক্ট’ নামের দুটি সংস্থা। বারাক ওবামা ও জন ম্যাককেইনের মধ্যকার ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে পর্যবেক্ষণের জন্য এই পুরস্কার পায় তারা। এশিয়ার মধ্যে ভারতে দুটি স্বীকৃত সংগঠন আছে যারা এ ধরনের কাজ করে থাকে। তবে বাংলাদেশে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পায়নি ডিউক রিপোর্টার্স ল্যাব।

২০১৭ সাল থেকে ২ এপ্রিল বিশ্ব ফ্যাক্ট চেকিং দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এবার দ্বিতীয়বারের মতো এ দিনটি পালনের আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক। এই সংস্থার উদ্যোগে Factcheckingday.com নামে একটি ওয়েবসাইটের যাত্রা শুরু হচ্ছে আজ। এর মাধ্যমে মানুষকে ভূয়া সংবাদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মিডিয়া লিটারেসি বাড়ানোর কাজ করা হবে।

বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও দ্বিতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং দিবস। দেশের প্রথম ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা BD Fact Check দিবসটি উপলক্ষে তাদের ওয়েবসাইটে (www.bdfactcheck.com) ফ্যাক্ট চেকিং সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের লেখা প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি ভুয়া তথ্য ছড়ানো রোধে গত দেড় বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে সংস্থাটি।

দিবসটি উপলক্ষে আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক’র পরিচালক অ্যালেক্সিস মানজারলিস এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমাদের আশা আমরা অন্তত একটা দিন আমরা যা পড়ি এবং সামাজিক মাধ্যমে যা শেয়ার করি তার যথার্থতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যয় করি।’

ভুল তথ্য ও বক্তব্য দিয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত বোকা বানাচ্ছেন সমাজের ক্ষমতাধর লোকেরা। আর আমরা বোকা হতে বাধ্য হচ্ছি কারণ প্রকৃত তথ্যটি আমাদের জানা নেই। প্রকৃত তথ্য জানাতে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের পরিসর বৃদ্ধি পেলে সুন্দর বুলিতে মানুষকে বোকা বানানো কঠিন হয়ে পড়বে। ক্ষমতায়িত হবে সাধারণ মানুষ।

কদরুদ্দীন শিশির
সাংবাদিক


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply