দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী যোদ্ধা ও সাবেক ফার্স্ট লেডি উইনি ম্যান্ডেলা ৮১ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি ছিলেন দেশটির বর্ণবাদ বিরোধী কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার স্ত্রী।
শ্বেতাঙ্গ শাসিত দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের কারণে নেলসন ম্যান্ডেলাকে প্রায় তিন দশক জেলে আটকে রাখা হয়েছিল। ওই সময়টাতে উইনি ও নেলসন ম্যান্ডেলা পরিণত হয়েছিল মানুষের অধিকার রক্ষার অনবদ্য আইকনে পরিণত হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন লুথার কিং জুনিয়নের পাশাপাশি এই দুই ব্যক্তিকে ধরা হয় বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে সংগ্রামী নেতা।
এক বিবৃতিতে উইনির পরিবার সোমবার তার মৃত্যুর খবর জানায় বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে।
খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ শোক সন্তপ্ত জনতা জোহানেসবার্গের সোয়েতো-তে অবস্থিত উইনির বাড়িতে ছুটে যায়।
সোমবার সকালে পরিবারের মুখপাত্র ভিক্টর দ্লামিনি বলেন, “সোমবার বিকালের শুরুতে উইনি ম্যান্ডেলা পরিবার-পরিজন ও প্রিয়মুখগুলোর সান্নিধ্যে থাকা অবস্থায় মারা যান।”
তিনি দীর্ঘ দিন ধরেই নানাবিধ শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন, এবং বছরের শুরু থেকেই হাসপাতালে যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলেন।
জাতির জননী
১৯৫০ সালে ভবিষ্যত স্বামী সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সময় তিনি ছিলেন একজন প্রশিক্ষিত সমাজ কর্মী। নেলসন ম্যান্ডেলাকে তৎকালীন শ্বেতাঙ্গ শাসিত সরকার আটকে রাখার কারণে দীর্ঘ ৩৮ বছর বিবাহিত জীবনের প্রায় ৩০ বছরই তাদের আলাদা থাকতে হয়েছিল। এই দম্পতির দু’টি কন্যা সন্তান রয়েছে।
নেলসনকে আটকে রাখার পর মিসেস মাদিকিজেলা-ম্যান্ডেলাই বর্ণবাদ বিরোধী বন্ধুর পথে সংগ্রামের মশালটি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি পরিণত হয়েছিলেন বিশ্বজুড়ে বর্ণবাদের প্রতিরোধ যোদ্ধার প্রতীকে। ন্যায় বিচার ও মানুষে মানুষে সমতার জন্য তাকেও জেল খাটতে হয়েছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণ তাকে আদর করে ডাকে “জাতির জননী।”
রাজনৈতিক জীবন
মিসেস উইনি ম্যান্ডেলার পুরো নাম নমজামো উইনিফ্রেড জানিউই মাদিকিজেলা। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পূর্ব ক্যাপ্টোউনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ওই সময় জায়গাটির নাম ছিল ট্রান্সকিই।
তার বাবা কলম্বাস ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি স্থানীয় শিশুদের শিখাতেন প্রকৃত ইতিহাস। ১৯৮৪ সালে উইনি নিজের আত্মজীবনীতে লিখেন, “আমাদের জন্য পাঠ্য বই ছিল, সাদা মানুষদের লেখা, এবং তার অনুবাদও তাদেরও মতোন করে দেওয়া হত। আমার হৃদয়ের একটা অংশ তার সাথে চলে গেছে। এরপর সে (কলম্বাস) বইটি পাশে রেখে বলতেন: ‘এখন, এই বইগুলো এমনই বলে, কিন্তু সত্য হচ্ছে: এই সাদা মানুষগুলো আমাদের দেশ দখল করেছে এবং আমাদের দাদাদের কাছ থেকে আমাদের ভূমিক চুরি করেছে।”
তিনি আরও লিখেছিলেন, “শিশু মনে এগুলো ক্ষোভ তৈরি করে, এবং এই ক্ষোভ ক্রমে কালো মানুষের মনে রাজনৈতিক সচেতনতার দৃঢ় প্রতীক্ষা গড়ে তোলে।”
জোহানেসবার্গের জেন এইচ হফমেয়ার স্কুল অব সোশাল ওয়ার্ক থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করার পর নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে তার পরিচয় ঘটে। এরপরই তিনি বর্ণবাদ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন যা আজকের দক্ষিণ আফ্রিকাকে চিত্রায়িত করে।
তাদের প্রথম ‘ডেট’ ছিল ম্যান্ডেলার আইন বিষয়ক অফিসের পাশে একটি ভারতীয় রেষ্টুরেন্টে। মশলাদার খাবারে অনভ্যস্ত উইনি’র অবস্থা দেখে সেদিন বেশ আমোদ পেয়েছিলেন তার ষোল বছরের বড় নেলসন ম্যান্ডেলা।
২৩ বছর বয়সের তুলনায় আরও বেশি পরিণত দেখানোর জন্য একটি স্যুট পরে এসেছিল উইনি। চুপচাপ বসেছিল সেদিন। যদিও ধার করে পরা স্যুটটিতে বেশ অস্বস্তি লাগছিল তার।
পথে হাটতে হাটতে চাঁদা তুলে তহবিল গঠনে উইনির সহায়তা চেয়েছিলেন নেলসন। পাথুরে পথে হাটার কারণে তার স্যান্ডেল ছিঁড়ে গিয়েছিল।
প্রথম ওই দিনটির কথা স্মরণ করে ১৯৯২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার টেলিভিশন ‘কার্ত ব্লঁঁশ’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উইনি বলেছিলেন, “রাজনীতিবিদরা প্রেমিক নয়।”
তথাপি এই দুইজন সম্পর্ক গড়েছিলেন, অন্যদের মানুষদের ভাষায় প্রগাঢ় ভালোবাসা। তারা প্রকাশ্যে হাত ধরে ঘুরতেন, জ্যাজ ক্লাবে যেতেন। কদাচিৎ বৎসাও হত।
উইনি তার আত্মজীবনে লিখেন, “প্রথম ‘ডেট’-এর এক বছর না হতেই নেলসন তাকে দর্জির বাড়ি নিয়ে যায়; এবং বলেছিল, পোশাক যেন মাপমতো হয়। সে জিজ্ঞেস করেছিল, কয়জন মিতকনে চায় সে (উইনি)।”
পুরনো সেই কথা স্মরণ করে তিনি লিখেন, “তাকে বিয়ে করার জন্য এভাবেই সে আমায় বলেছিল। আমি জানতে ছিলাম, কোন সময়? আমি তার প্রেমে পাগল ছিলাম।”
এরপর তাদের দাম্পত্য জীবন কেটে গিয়েছিল শ্বেতাঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে। ১৯৫৮ সালে কালো নারীদের চলাচলের ওপর আরোপিত বিধি নিষেধের বিরুদ্ধে গণ প্রতিরোধ মিছিলে যোগ দিলে তাকে কারাগারে বন্দী করা হয়েছিল।
সেই থেকেই জীবনের পুরোটা সময়জুড়ে তিনি মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করে গেছেন।
যমুনা অনলাইন: এফএইচ
Leave a reply