জিল্লুর রহমান পলাশ, গাইবান্ধা
‘দেড় বছর বয়সে রানা প্লাজার মৃত্যুকুপে মাকে হারিয়েছে ছোট শিশু জেরিন। মাকে হারানোর পরে দাদির কোলে ঠাঁই হয়েছে জেরিনের। ঘরে থাকা ফ্রেমে বাঁধা ছবি হাতে নিয়ে আজও মাকে খুঁজে ফেরে জেরিন। মাকে মনে করতে আর মায়ের কথা বলতেই কেঁদে উঠে ৭ বছরের শিশু জেরিন’।
জেরিনের সাথে কথা হলে সে বলে, ‘মায়ের সাথে ঢাকায় থাকতে প্রতিদিন মা কাজে যাওয়ার আগে তাকে আদর করে ভাত তুলে খাওয়াত। কাজ শেষ করে বাসায় ফিরেও মুখে ভাত তুলে দিতো। মা তাকে খুব আদর করতো, অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু আজ মা নেই, মার কথা খুব মনে পড়ে’।
এভাবে কথাগুলো বলছিলো মা হারানো শিশু জেরিন। জেরিন গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের দামোদরপুর গ্রামের রানা প্লাজার মৃত্যুকুপে মারা যাওয়া লিপি বেগমের একমাত্র সন্তান। লিপি বেগম ওই গ্রামের জিয়াউর রহমানের স্ত্রী।
জেরিনের বাবা জিয়াউর রহমান বলেন, ‘সংসারে অভাবের কারণে স্ত্রী লিপি বেগম স্বপ্ন দেখতেন নিজের সংসারকে সাজানোর। আর লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন আদরের একমাত্র সন্তানকে। এমন তাড়নায় গ্রামের আর দশজনের সাথে পাড়ি জমান ঢাকায়। চাকরি নেন রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় সুইমিং হেলপারের। কিন্তু চাকরি করার কিছুদিন না যেতেই ভবন ধ্বসে মারা যায় লিপি। পরে ১৭ দিন পর লাশ উদ্ধার করে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়’।
তিনি আরও বলেন, ‘স্ত্রী মারা যাওয়ার সময় জেরিনের বয়স মাত্র দেড় বছর। দেড় বছরের জরিন তখন থেকে তার দাদির কাছে থেকে বড় হচ্ছে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই দফায় প্রায় ৪ লাখ টাকা পেয়েছেন। ক্ষতিপূরণের টাকায় কিনেছেন সামান্য জমি আর একটি মাইক্রোবাস। প্রতিদিন মাইক্রোবাসের ভাড়ার চলে সংসার। মেয়েকে ভর্তি করেছেন স্থানীয় কান্তনগর প্রি ক্যাডেট স্কুলের নার্সারীতে। কষ্ট হলেও মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে স্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করতে চান তিনি’।
একই ইউনিয়নের দক্ষিণ দামোদরপুর গ্রামের সোনিয়া বেগম। বিয়ের দু’বছর পর বেকার স্বামীকে নিয়ে রানা প্লাজার একটি কারখানায় কাজ শুরু করেন। চাকরির ২২ দিনের মাথায় ভবন ধসের ঘটনায় চাপা পড়েন সোনিয়া। তিনদিন পর উদ্ধার হলেও সোনিয়ার ডান পা কোমরের নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়।
সোনিয়া বেগম বলেন, ‘এখনো সেদিনের কথা মনে পড়লে ভয়ে আতকে উঠেন। ক্ষতিপূরণ যা পেয়েছেন তা দিয়ে বাড়িতে করেছেন ছোট দোকান। পাঁচ বছর ধরে এক পা আর ক্রেস্টের উপর ভর করেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছে তাকে। সামান্য আয়ে কোনো রকমে সংসার চলছে। এখনো শারীরিক অনেক সমস্যায় ভুগতে হয় তাকে’।
সোনিয়ার স্বামী মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাড়িতে ছোট আকারের মনিহারি দোকান দুজনেই দেখাশোনা করি। দেড় বছরের শিশু মিম আর বাবা-মাকে নিয়ে সংসার। ক্ষতিপূরণের টাকায় কোন রকমে চলে সংসার। তবে চেষ্টা করেও সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে পারছেন না। সরকার চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো চাকরি পাইনি। চাকরি আর পুনরায় ক্ষতি পূরণ দেয়ার জন্য সরকারের নিকট দাবি জানান তিনি’।
শুধু লিপি বেগম আর সোনিয়াই নয়, এই ইউনিয়নের অনেকে কাজ করতেন রানা প্লাজায়। তাদের মধ্যে স্মৃতি, রেবা, সবুজ, মোকছেদ, ইউনুস আলী ও সুমিসহ ১১ জন লাশ হয়ে বাড়ি ফেরেন। রানা প্লাজা ভবন ধসে সরকারি হিসেবে গাইবান্ধা জেলায় নারীসহ অর্ধশতাধিক নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এছাড়া আজও নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ১৫ জন। তবে এসব নিহত, আহত ও নিখোঁজদের অধিকাংশের বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলায়।
সরেজমিনে দামোদরপুর ইউনিয়নের কয়েকজন নিহতের স্বজনের ও আহতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভালো নেই তাদের পরিবার। দুর্ঘটনায় শুধু আপনজনদের কেড়ে নেয়নি, নিয়ে গেছে পরিবারগুলোর সব স্বপ্ন আর আনন্দ উল্লাস। ভয়াবহ সেই দু:সহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে অাহতদের। তাছাড়া ঘটনার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজ অনেকের লাশের সন্ধান না মেলায় স্বজনদের আহাজারি থামেনি এখনো। অনেকে পাইনি কোন ক্ষতিপূরণ। প্রাণে বেঁচে যাওয়া অনেকেই শারীরিক পঙ্গুতা নিয়ে নানা কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। তাছাড়া দুর্ঘটনার জন্য দায়িদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ বিরাজ করছে অনেকের মনে।
দক্ষিণ ভাঙামোড় গ্রামের বীথি রোজগারের আশায় বড় বোনের সাথে চাকরি নেয় রানা প্লাজায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে বড় বোন। কিন্তু মৃত্যুকুপে নিখোঁজ বীথির লাশ আজও খুঁজে পায়নি পরিবার। সন্তান হারানো শোক কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাবা-মা। তাছাড়া লাশ তো দূরের কথা, মেলেনি কোন অর্থ সাহায্যে। সাদুল্যাপুর উপজেলার সাতজনসহ গাইবান্ধা জেলার ১৫ শ্রমিক এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও গাইবান্ধা জেলা পরিষদের সদস্য মনোয়ারুল হাসান জিম মণ্ডল বলেন, ‘ভবন ধ্বসের পর পরেই নিহত ও আহতদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয়েছিলো। সেই সহযোগিতার অর্থ দিয়ে কোন পরিবারেই আজও ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারেননি। অনেকে নানা কষ্টেই দিনাতিপাত করছেন। তাছাড়া দামোদরপুর ইউনিয়নের নিখোঁজ অনেকের লাশ পায়নি পরিবার। এমনকি তাদের দেয়া হয়নি কোন সাহায্যেও। ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের খোঁজ খবর নিয়ে পুনরায় তালিকা করে সহযোগিতার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসার দাবি জানাই।
জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ পাল বলেন, ‘হতাহতের পরিবারগুলোকে তালিকার মাধ্যমে সহযোগিতা করা হয়। তাছাড়া এসব পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা করে আসছেন জনপ্রতিনিধিরা। তবে তাদের সহযোগিতার জন্য সুযোগ সৃষ্টি হলে অবশ্যই সহযোগিতা করা হবে’।
তবে ভবন ধসে নিহতদের পরিবারকে পুনর্বাসন, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং আহতদের চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দিলে অল্প সময়ের মধ্যে এসব পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এমনটাই প্রত্যাশা হতাহতদের স্বজন ও এলাকাবাসীর।
Leave a reply