সম্প্রতি রাজধানীর শাহাজানপুর আমতলা মসজিদ এলাকায় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুর রহমান টিপু ও কলেজ শিক্ষার্থী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন আসামী শ্যুটার মাসুম মােহাম্মদ আকাশকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গােয়েন্দা পুলিশ। আলােচিত এই মামলার হত্যা রহস্য উদঘাটনে কোমর বেঁধে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। অবশেষে সফল হয় ঢাকা মহানগর গােয়েন্দা পুলিশ। সন্দেহভাজন প্রধান শ্যুটার আকাশকে গ্রেফতারের এ অভিযানে অসাধারণ চাতুর্যের পরিচয় দিয়েছেন ডিবি মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শাহিদুর রহমান রিপন।
মতিঝিল বিভাগ ডিবির ডিসি রিফাত শামীমের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়নে রুপালি পর্দার কাহিনিকেও হার মানানাে এই গ্রেফতার অভিযানে তিনিসহ অংশ নেয় গােয়েন্দা পুলিশের চারটি টিম, যাতে অন্তত ৬০ জন পুলিশ সদস্য অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ডিবি মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনারসহ পুরাে টিমের অক্লান্ত পরিশ্রমে শেষ পর্যন্ত বগুড়া থেকে গ্রেফতার হন শ্যুটার আকাশ। অভিযানে তাদের সহায়তা করেছে বগুড়া জেলা পুলিশ।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক টিপুকে এলােপাতাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। যানযটে আটকে থাকা টিপুর গাড়ি লক্ষ্য করে চালানো এলােপাতাড়ি গুলিতে টিপুসহ নিহত হন রিকশা আরােহী এক কলেজছাত্রী সামিয়া আখতার প্রীতি।
গােয়েন্দা কর্মকর্তা শাহিদুর রহমান রিপন জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে হত্যার সময়কার একটি সিসিটিভি ফুটেজ ছাড়া তাদের কাছে আর কিছুই ছিল না। প্রধান শ্যুটারের মাথায় হেলমেট থাকায় কোনোভাবেই তাকে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, আমরা টিপু হত্যার আগের ও পরের বেশ কিছু সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালােচনা করি। সেখানে লক্ষ করি এজিবি কলােনি বাজারে টিপুর রেস্তোরাঁর সামনে একটি মােটরসাইকেলে সন্দেহভাজন দুজনের অবস্থান। হত্যার সময়কার সিসিটিভি ফুটেজ আর এজিবি কলােনির ফুটেজ দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় মােটরসাইকেল আরােহী দুজনই এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত।
এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, খুনের কোনো ক্লু না থাকায় আমরা ঢাকা শহরের ৫ জন শ্যুটারের বিষয়ে খোঁজ নিতে শুরু করি, কিন্তু শ্যুটাররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মােবাইল ফোন ব্যবহার করে না। পরে তাদের সাথে যারা থাকে, তাদের মোবাইল ট্র্যাকিং করে এক পর্যায়ে সন্দেহের তালিকা ৫ জন থেকে নামিয়ে ২ জনে নিয়ে আসা হয়।
দুজন শ্যুটারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের এক পর্যায়ে গোয়েন্দারা দেখেন, একজন শ্যুটার সঙ্গীসহ জয়পুরহাট থেকে বগুড়ার দিকে ফিরছে। কিছুক্ষণ পর শ্যুটারের সঙ্গী ঢাকায় ফিরতে শুরু করলে, গোয়েন্দারা ধারণা করেন, ওই ব্যক্তি শ্যুটারকে জয়পুরহাট কিংবা বগুড়ায় রেখে ঢাকায় ফিরে আসছে। অনুসন্ধানের এই পর্যায়ে কাকতলীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্লু পান গােয়েন্দারা।
অভিযানের নেতৃত্বে থাকা গোয়েন্দা কর্মকর্তা এডিসি শাহিদুর রহমান রিপন বলেন, জয়পুরহাট থেকে যে ঢাকায় আসছিল, তার মােবাইলে একজন কল দিয়ে বলে, ও কই? জবাবে সে বলে, আমার সাথে নাই। এই বলে সে তার ফোন কেটে দেয়। এর পাঁচ মিনিট পরই তার মােবাইল নাম্বারে একই নাম্বার থেকে কল আসে। মােবাইলের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, দিনা (শ্যুটার আকাশের স্ত্রী) বারবার ফোন দিচ্ছে, ও মনে হয় সন্দেহ করেছে গতকালের ঘটনা নিয়ে। এর পরই ফোন কেটে যায়।
এর ১০ মিনিট পর একই নাম্বার থেকে কল করে বলা হয়, দিনা বারবার ফোন দিচ্ছে, আমি কী বলবাে? তখন শ্যুটারের সঙ্গীর প্রান্ত থেকে বলা হয়, তুই ২০ হাজার টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে আয়। এই কথোপকন শােনার পরেই আসল শ্যুটার কে, তা নিশ্চিত হন গােয়েন্দারা।
দুজন শ্যুটারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের এক পর্যায়ে গোয়েন্দারা দেখেন, একজন শ্যুটার সঙ্গীসহ জয়পুরহাট থেকে বগুড়ার দিকে ফিরছে। কিছুক্ষণ পর শ্যুটারের সঙ্গী ঢাকায় ফিরতে শুরু করলে, গোয়েন্দারা ধারণা করেন, ওই ব্যক্তি শ্যুটারকে জয়পুরহাট কিংবা বগুড়ায় রেখে ঢাকায় ফিরে আসছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা শাহিদুর রহমান রিপন বলেন, এরপর শ্যুটার আকাশের স্ত্রী দিনাকে টাকা দিয়ে ফেরার সময় আমরা ওই ব্যক্তিকে ধরে ফেলি। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সে জানায়, দিনা তাকে বলেছে টিভিতে টিপু হত্যার যে সিসিটিভি ফুটেজ দেখানাে হচ্ছে, সেখানকার শ্যুটারকে তার স্বামী আকাশের মতো মনে হচ্ছে। তাই আকাশ কোথায় সেটা জানতে বারবার তাকে ফোন করেছে দিনা।
পুরােপুরি নিশ্চিত হয়ে গােয়েন্দারা আকাশের স্ত্রী দিনাকে ডিবি অফিসে নিয়ে এসে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। প্রথম দিকে দিনা মুখ না খুললেও অবশেষে গােয়েন্দাদের জেরার মুখে তিনি ডিবিকে সব বলতে বাধ্য হন। তবে দিনার কাছ থেকে আকাশের অবস্থান বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাননি গােয়েন্দারা। তবে দিনার কাছ থেকে আকাশের একটি ছবি পান তারা।
ঠিক সেসময় তথ্য আসে জয়পুরহাট হয়ে বগুড়া ঘুরে আসা ব্যাক্তি ঢাকায় চলে এসেছেন। এরপরই গােয়েন্দাদের একটি টিম তাকে নিজ বাসার সামনে থেকে ধরে নিজেদের হেফাজতে নেয়। ওই ব্যক্তির কাছেই পাওয়া যায় বগুড়ার একটি হোটেলে আকাশের অবস্থানের তথ্য। উপ-পুলিশ কমিশনার শাহিদুর রহমান রিপন বলেন, ওই ব্যক্তিকে নিয়ে আমরা শ্যুটার আকাশকে ধরতে বগুড়ার দিকে রওনা হই। ঢাকা থেকে বগুড়া যেতে যে সময় লাগবে এর মধ্যে আকাশ তার অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। তাই তারা আকাশের বিস্তারিত তথ্য পাঠিয়ে দেন বগুড়ার এসপি সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর কাছে। এরপর বগুড়া জেলা পুলিশ শহরের চারমাথা এলাকার আবাসিক হােটেল খাজা থেকে শ্যুটার আকাশকে গ্রেফতার করে।
সব কাজ সতর্কতার সাথে করেও গ্রেফতার হওয়ায় শ্যুটার আকাশ বিস্মিত। গােয়েন্দা দলের মুখোমুখি হয়েই আকাশ বলেন, স্যার আমি তাে এই কাজে কোনো ভুল করিনি তাহলে আপনারা আমাকে আইডেন্টিফাই করলেন কীভাবে?
/এডব্লিউ
Leave a reply