আলোচিত টিপু-প্রীতি হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে যে, এ হত্যাকাণ্ডটি দেশে সংঘঠিত হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে দুবাই থেকে। দেশ থেকে কিলার নাছির, কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েকদিন যাবত মুসার কাছে তথ্য পাঠাতো বলেও জানিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা।
জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত মোরশেদুল আলম টিপুকে হত্যার উদ্দেশে ফারুক ও মুসাকে ফোনে কয়েকজন আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে চূড়ান্ত সমন্বয়ের জন্য মুসা গত ১২ মার্চ দুবাইয়ে যায়। সেখানেই হত্যাকাণ্ডের চুড়ান্ত সমন্বয় করা হয় বলে জানিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা।
শুক্রবার (১ এপ্রিল) বহুল আলোচিত এবং চাঞ্চল্যকর রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় জাহিদুল ইসলাম টিপু এবং সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড এবং হত্যাকাণ্ডের সময় টিপুকে অনুসরণকারীসহ ৪ জনকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
এর আগে, গত ২৪ মার্চ রাত আনুমানিক সাড়ে দশটায় দুস্কৃতিকারীর গুলিতে জাহিদুল ইসলাম টিপু নিহত হন। এছাড়া নিহত হন ঘটনাস্থলে নিরীহ কলেজ ছাত্রী প্রীতি। এর প্রেক্ষিতে নিহত টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি শাহজাহানপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডে বিশেষ করে কলেজ ছাত্রী প্রীতি নিহত হওয়ায় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি ও মিডিয়াতে গুরুত্বের সাথে সংবাদ প্রচারিত হওয়ায় এ ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে র্যাব। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বৃদ্ধি করা হয় গোয়েন্দা নজরদারী।
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব -৩ এর অভিযানে শুক্রবার (১ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর এলাকা হতে ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ওমর ফারুক (৫২), আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ (৩৮), কিলার নাছির (৩৮), ও মোঃ মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ (৫১) কে গ্রেফতার করা হয়। উক্ত অভিযানে উদ্ধার করা হয় নজরদারীর কাজে ব্যবহৃত মোটর সাইকেল এবং হত্যার কাজে প্রদান যোগ্য ৩ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইলসহ অন্যান্য সামগ্রী।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা বর্ণিত হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হত্যার মোটিভ বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানায় যে, দীর্ঘদিন যাবৎ ভিকটিম ও হত্যার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বিরোধ ছিল। মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলমান রয়েছে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরম্পরায় গত ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই তারিখে গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ড এর সামনে মিল্কী হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয়। মিল্কী হত্যাকান্ডের ৩ বছরের ভেতর একই এলাকার বাসিন্দা রিজভি হাসান ওরফে বোচা বাবু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায় যে, মিল্কী হত্যাকাণ্ডের সাথে টিপুর সম্পৃক্ততা রয়েছে মর্মে গ্রেফতারকৃত ওমর ফারুক, পলাশসহ একটি পক্ষ মানববন্ধন, আলোচনা সভা, পোস্টার লাগানো ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়া বাদীর মাধ্যমে চার্জশিটের নারাজী প্রদানের মাধ্যমে চেষ্টা চালায়। তারপরও জাহিদুল ইসলাম টিপু মামলা হতে অব্যাহতি পায়।
পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত ওমর ফারুক ও অন্যান্য সহযোগীরা স্বার্থগত দ্বন্দের কারণে টিপুর অন্যতম সহযোগী রিজভী হাসানকে ২০১৬ সালে হত্যা করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের ধারণা প্রতিপক্ষ টিপুর কারণেই রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে স্থানান্তরিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে, মামলার বাদী রিজভী হাসান বাবুর পিতা আবুল কালামের সাথে গ্রেফতারকৃত ওমর ফারুক ও তার সহযোগীরা ৫০ লক্ষ টাকায় দফারফা করার চেষ্টা করে। তারপরও জাহিদুল ইসলাম টিপুর কারণে কালাম মীমাংসায় আসেনি বলে গ্রেফতারকৃতরা জানায়।
এরপর, জাহিদুল ইসলাম টিপু কালামকে নিয়ে সার্বক্ষণিক চলাচল করতে থাকে। তারা এক পর্যায়ে কালামকে হত্যা করার পরিকল্পনা করলেও টিপুর সাথে সার্বক্ষণিক চলাচল করার কারণে তা সম্ভব হয়নি। অতঃপর, কালামের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে তারা টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করে যাতে মামলাটির গতি কমে যায়। তাদের ধারণা, কালাম একা মামলাটি ঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবে না। এর প্রেক্ষিতে, প্রায় ৩ মাস আগে সাক্ষ্যপ্রদান শেষে আদালত চত্ত্বর এলাকায় হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক আলোচনা করে গ্রেফতারকৃতরা।
গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায় যে, রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সাক্ষী গ্রেফতারকৃত মো. মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশকে তারা অর্থের বিনিময়ে সাক্ষ্য প্রদানে বিরত থাকতে বললে মোরশেদুল আলম রাজী থাকা সত্ত্বেও পরে টিপুর চাপে সাক্ষ্য দেয়। মোরশেদুল পরবর্তীতে রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতারকৃত আসামিদের সাথে যুক্ত হয়ে টিপুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়।
গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায় যে, হত্যাকাণ্ডটি দেশে সংঘঠিত হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা হয় দুবাই থেকে। দেশ থেকে কিলার নাছির, কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েকদিন যাবত মুসার কাছে তথ্য পাঠাতো।
গ্রেফতারকৃত মোরশেদুল আলম হত্যাকান্ড বাস্তবায়নের জন্য ফারুক ও মুসাকে ফোনে কয়েকজন আন্ডার ওয়ার্ল্ড এর সন্ত্রাসীদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সমন্বয়ের জন্য মুসা গত ১২ মার্চ দুবাইয়ে যায়। সেখানেই হত্যাকাণ্ডের চুড়ান্ত সমন্বয় করা হয়।
ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর গ্রেফতারকৃত মোঃ নাছির উদ্দিন @ কিলার নাছির আনুমানিক চারবার জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে অবহিত করে। পরবর্তীতে জাহিদুল ইসলাম টিপুর গ্রান্ড সুলতান রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় কাইল্লা পলাশ তাকে নজরদারিতে রাখে এবং তার অবস্থান সম্পর্কে সে ফ্রিডম মানিককে অবহিত করে। বর্ণিত অবস্থান সম্পর্কে জানানোর প্রেক্ষিতে আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টায় আন্ডার ওয়ার্ল্ড এর তত্ত্বাবধানে টিপুকে হত্যা করা হয় বলে জানায় গ্রেফতারকৃতরা।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, গ্রেফতারকৃত ওমর ফারুকের সাথে বর্ণিত হত্যাকাণ্ডের জন্য ১৫ লক্ষ টাকার চুক্তি হয়। উক্ত ১৫ লক্ষ টাকা রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডের আসামিদের মধ্যে ওমর ফারুক ৯ লক্ষ ও অবশিষ্ট টাকা কিলার নাছিরকে দেয়া হয়।
/এসএইচ
Leave a reply