সাবেক এমপি করিম উদ্দিন ভরসাকে প্রকাশ্যে আনতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান সন্তানরা

|

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, রংপুর:

জাতীয় পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক সংসদ সদস্য ও বিশিষ্ট শিল্পপতি করিম উদ্দিন ভরসা (৮৭) ‘জীবিত নাকি মৃত’ ৯ সন্তানের হেবিয়াস করপাস আবেদনের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ সত্বেও অপর দুই পুত্র রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির করেননি তাকে।

শনিবার (১৬ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে তাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। এখন ওই সন্তানেরা পিতাকে প্রকাশ্যে আনতে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।

আদালত সূত্র জানিয়েছে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারী হাইকোর্টে সাইফুল উদ্দিন ওরফে শিমুল ভরসা জিম্মায় নিয়ে করিম উদ্দিন ভরসাকে বেআইনিভাবে আটক রেখেছেন বলে হেবিয়াস করপাস অভিযোগ করেন তার অপর সন্তান শফিকুল ইসলাম ভরসা, কামরুল ইসলাম ভরসা, জোসনা আরা বেগমসহ ৯ সন্তান।

করিম উদ্দিনের ৯ সন্তানের করা ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। আদেশে ছেলে সাইফুল উদ্দিন ভরসার হেফাজতে করিম উদ্দিন ভরসাকে আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূতভাবে আটক রাখা হয়নি, তা নিশ্চিতে আদালতের সামনে তাকে হাজির করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে করিম উদ্দিন ভরসাকে আবেদনকারীদের (৯ সন্তান) যৌথ নিরাপদ হেফাজতে কেন দেয়া হবে না, তা–ও জানতে চাওয়া হয় রুলে।

স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার, করিম উদ্দিন ভরসার ছেলে সাইফুল উদ্দিন ভরসা, রংপুর কোতোয়ালি থানার ওসি এবং ঢাকার গুলশান থানার ওসিকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। আদেশে ওই দিনই সাইফুল উদ্দিন ভরসার ওপর ৬ মার্চ করিম উদ্দিন ভরসাকে সশরীরে হাইকোর্টে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়।

ওই আদেশের বিরুদ্ধে গত ৩ মার্চ আপিল আবেদন করলে সুপ্রিম কোর্ট ছয় সপ্তাহের জন্য ওই আদেশ স্থগিত করে। ওই স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে শফিকুল ইসলাম ভরসাসহ নয় সন্তান ফের আবেদন করলে করিম উদ্দিন ভরসাকে হাজির করে এক সপ্তাহ পর পর প্রতি শনিবার অপর ছেলেমেয়েদের দেখার সুযোগ করে দেয়ার জন্য রংপুরের জজ আদালতকে নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।

সে অনুযায়ী গত ২ এপ্রিল করিম উদ্দিন ভরসাকে রংপুর জজ আদালতে হাজির করার কথা থাকলেও সেদিনও আদালতে করিম ভরসাকে হাজির করেনি ওই পুত্র। তখন রংপুর জজ আদালত আবারও ১৬ এপ্রিল করিম ভরসাকে হাজির করার দিন ধার্য করেন। কিন্তু শনিবার (১৬ এপ্রিল) তাকে হাজির করা হয়নি।

রংপুর জজ আদালতে উপস্থিত তার অন্য সন্তানেরা জানিয়েছেন, বিচারক আবারও তাদের সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সম্পত্তির লোভে তার দুই ভাই তাদের পিতাকে জিম্মায় নিয়ে কৌশলে জিম্মি করে রেখেছেন। তিনি বেঁচে আছেন কিনা আমরা জানি না। এ ব্যপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন তারা।

রংপুর আদালতে উপস্থিত করিম উদ্দিন ভরসার দ্বিতীয় পুত্র এফবিসিসিআই এর পরিচালক শফিকুল ইসলাম ভরসা জানান, আমার দুই ভাই সিরাজুল ইসলাম ভরসা ও সাইফুল ইসলাম ওরফে শিমুল ভরসা আমার বাবাকে নিজেদের কাছে নিয়ে জিম্মি করে রেখেছে সম্পত্বি হাতিয়ে নেয়ার জন্য। আমাদের বাধ্য হয়ে আইনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট হয়ে জজ কোর্টের কাছে যেতে হয়েছে। আমরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছি। সুপ্রিম কোর্ট আমাদেরকে পিতার সাথে দেখার করার সুযোগ করে দিয়েছেন। সেই নির্দেশের আলোকে রংপুর জজ কোর্টে গত ২ এপ্রিল এবং আজ (১৬ এপ্রিল) আমরা আমাদের পিতার সাথে দেখার জন্য ভাইবোনেরা এসেছি। কিন্তু আমার ওই দুই ভাই গত ২ এপ্রিলও আমার বাবাকে হাজির করেনি। আজও করলো না।

তিনি অভিযোগ করেন, আমরা খুব শঙ্কিত ও ভীত যে আমাদের বাবা বেঁচে আছেন কিনা, সুস্থ আছেন কিনা। এটা নিয়ে আমরা খুবই শঙ্কিত অবস্থায় আছি। তিনি আরও বলেন, আমার বাবা তিনবারের এমপি, জনপ্রিয় নেতা। ওনার মতো একজন ব্যক্তিকে এভাবে আমরা সন্তানেরা আইনের দ্বারস্থ হয়েও দেখা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এটা সন্তান হিসেবে মেনে নেয়া যায় না।

সপ্তম পুত্র কামরুল ইসলাম ভরসা জানান, আমরা চাচ্ছি আমাদের বাবার সাথে দেখা করতে, তাকে বাবা বলে ডাকতে। এলাকার মানুষের জন্য উনি অনেক কাজ করেছেন। এলাকার মানুষ আমাদের প্রশ্ন করে তার সম্পর্কে। আমরা কিছুই বলতে পারিনা। আমাদের কারখানাগুলোতে হাজার হাজার মানুষ কাজ করতো। এখন এই জটিলতায় সব বন্ধ আছে। শ্রমিকরা আমাদের বারবার প্রশ্ন করে কবে কারখানা চালু হবে? তা আমরা বলতে পারি না। আমরা আইনের কাছে গেছি। কিন্তু আইনকে অমান্য করে আমার ছোট ভাই ও বড়ভাই তাকে গুম করে রেখেছেন। তিনি জীবিত না মৃত আমরা কিছুই জানতে পারছি না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের বাবার যদি কিছু হয়, তাহলে আমরা আমাদের ওই দুইভাইকে ছাড়বো না। তিনি বলেন, উপমহাদেশের ইতিহাসে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের ছেলে আওরঙ্গজেব তার পিতাকে কৌশলে বন্দী করে রাখে সিংহাসনের জন্য। এরপর আমাদের পরিবারে এই ঘটনা ঘটলো। এটা তার সন্তান হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক।

বাবাকে দেখতে আসা বড় কন্যা জোসনা আরা বেগম জানান, বহুদিন আব্বাকে দেখি না। শিমুল আর সিরাজুলে আব্বাকে জিম্মায় নিয়েছে। আদালতের নির্দেশ আসার পর আমি শুধু আব্বাকে দেখতে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসলাম। অথচ ওরা আব্বাকে আদালতে হাজির করলো না। আইনকেও ওরা মানে না। আমরা আমাদের আব্বাকে সুস্থভাবে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে চাই।

মামলা, আইনজীবী এবং পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, করিম উদ্দিন ভরসার দুই স্ত্রীর ঘরে ১৬ জন সন্তান আছেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ সেপ্টেম্বর রংপুর আদালতের এক আদেশে করিম উদ্দিন ভরসাকে তার প্রথম স্ত্রীর সন্তান সাইফুল উদ্দিন ভরসার জিম্মায় দেন। এরপর তার সঙ্গে আর দেখা করতে পারছেন না অপর সন্তানেরা। আট মাস ধরে তারা তাদের বাবার খোঁজও জানতে পারছেন না। এখন যার জিম্মায় আছে সেই পুত্র সাইফুল উদ্দিন ভরসা ও বড় পুত্র সিরাজুল ইসলাম ভরসার বিরুদ্ধে পিতা করিম উদ্দিন ভরসা বাদি হয়ে ২০১৭ সালে হত্যা চেষ্টা, হুমকি ও মারপিট করার অভিযোগে মামলা করেছিলেন (মামলা নং সিআর-৬২১/১৭)। এই মামলার পর সাইফুল ও সিরাজুল ভরসা বাদি হয়ে গত ৩০-১১০২০১৭ তারিখে রংপুর জজ আদালতের কাউনিয়া সহকারী জজ আদালতে করিম উদ্দিন ভরসাকে মানসিক ভারসাম্যহীন ডিক্রির জন্য একটি মামলা দায়ের করেন ( নং-অন্য ১৪১/১৭)।

উল্লেখ্য, করিম উদ্দিন ভরসা জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ছিলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) আসন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৪ (কাউনিয়া-পীরগাছা) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply