ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ:
টার্গেট-৭ এ নতুন দূষণের সংযোজন
কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি সেক্রেটারিয়েটের হেড অব কমিউনিকেশন ডেভিড এইন্সওরর্থ। তার সাথে কথা হয় টার্গেট-৭ এর বিষয়ে। আমি প্রশ্ন করি, টার্গেট-৭ নিয়ে কী আলোচনা হলো ওয়ার্কিং গ্রুপ মিটিংয়ে? ডেভিট জানান, গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে বিশেষভাবে দূষণের বিষয়ে বলা আছে টার্গেট-৭ এ। মজার বিষয় হলো এই টার্গেট-৭ এ সব ধরনের দূষণের কথাই বল হয়েছে। আগের বায়োডাইভারসিটি টার্গেট কেবল ফোকাস করা হয়েছিল নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ, এবং যা পানির সিস্টেমকে মৃত্যুকূপে পরিণত করে। সুতরাং টার্গেটে নতুন প্রস্তাব কেবল ফার্টিলাইজার হিসেবে নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসের বন্ধের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে না পাশাপাশি এটি পেস্টিসাইড বা বালাইনাশক বা কীটনাশক বন্ধের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
ডেভিট যোগ করেন, পাশাপাশি এই টার্গেট সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে প্লাস্টিক দূষণের ওপর। এই টার্গেট যদি পাস হয় তাহলে তা পরিবেশের জন্য দারুণ উপকারী হবে, বিশেষ করে পানি দূষণ ও সমুদ্রে দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে পানি দূষণ, প্লাস্টিক ও কীটনাশকের ব্যবহার
পানি দূষণ
এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬ শীর্ষক প্রতিবেদনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ৪৮টি দেশের পানিসম্পদের অবস্থা তুলে ধরা হয়। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে বাংলাদেশে। আর নদী অববাহিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবনতি হয়েছে নেপাল, ভারত, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার পানি।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে তুলনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবি। এতে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে মাটির ওপরে ও নিচে, দুই ধরনের পানিরই অবস্থা খারাপ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহর ও শিল্পাঞ্চলগুলোর ৮০ শতাংশ পয়োবর্জ্য কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই পানিতে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে নদীগুলোতে রাসায়নিক পদার্থের দূষণ বাড়ছে। নদীর স্বাস্থ্য দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। নদীর স্বাস্থ্যের অবনতির দিক থেকে শীর্ষে গঙ্গা অববাহিকার দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল।
পানি বিষয়ক এই প্রতিবেদন তৈরির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এডিবির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা এক হাজার কোটি হবে। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোতে খাবার ও পানির চাহিদা বাড়বে। এই সময়ের মধ্যে গৃহস্থালি কাজে পানির চাহিদা ৫৫ শতাংশ ও কৃষিতে ৬০ শতাংশ বাড়বে। ফলে পানির টেকসই ব্যবহার এবং পানির উৎসগুলো সংরক্ষণের দরকার হবে।
পানি দূষণের বিষয়ে একই ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা-২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে৷ শিল্পকারখানাগুলো অপরিকল্পিতভাবে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানি তুলে ফেলছে৷ ফলে পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে৷ ফলে খাল ও নদীসহ অন্যান্য জলাশয়ের পানিও মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে৷
৭১৯টি তৈরি পোশাকশিল্পের ওয়াশিং ও ডাইং কারখানার বর্জ্য দূষণের অন্যতম উৎস৷ এক টন কাপড় উৎপাদন করতে নদীতে বর্জ্য যাচ্ছে ২০০ টন৷ ইস্পাত কারখানাগুলো থেকে ১ লাখ কোটি লিটার এবং কাগজ কারখানাগুলো থেকে ৪৫ হাজার কোটি লিটার দূষিত বর্জ্য পানিতে মেশে৷
ঢাকার পাশাপাশি ছোট জেলা শহরগুলোতে জলাশয় ভরাট, দখল ও দূষণ চলছে৷
প্লাস্টিক ব্যবহার
২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে ২০০৫ থেকে ২০২০ সাল অর্থাৎ গত ১৫ বছরে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে তিনগুণ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম প্লাস্টিক দূষণের দেশ। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০০৫ সালে দেশে গড়ে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ১ কেজি। ঢাকায় ছিল ৯ দশমিক ২ কেজি। ২০১৪ সালে তা যথাক্রমে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫ কেজি ও ১৭ দশমিক ২ কেজি। এছাড়া ২০২০ সালে দেশে গড়ে ৯ কেজি এবং ঢাকায় ২৪ কেজিতে পৌঁছেছে। সংস্থাটির টুওয়ার্ডস আ মাল্টিসেক্টোরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাস্টেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
মজার বিষয় হলো, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার নিয়ে গবেষণাটি করেছে বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণ এবং যুবকরাই পরিবেশে প্লাস্টিক দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। যেসব খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিকের প্যাকেট রয়েছে, সেগুলোই সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে তরুণ এবং যুবকেরা, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
কীটনাশকের ব্যবহার
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণা পরিষদের (এনএফএসএল) গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৬৫ হাজার ১৪২ টন কীটনাশক সবজি ও ফসলে ব্যবহার হয়েছে। এর পরিমাণ গত ১০ বছরের চারগুণ। এর বাইরে বছরে প্রায় পাঁচ হাজার টন কীটনাশক চোরাইপথে বাংলাদেশে আসে। কীটনাশক নির্দিষ্ট মাত্রায় ফল, সবজি ও ফসলে দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, প্রতি বছর দেশে ৩০ হাজার টনেরও বেশি কীটনাশক আমদানি করা হয়। ডিডিটি ও ক্লোরিন গ্রুপের কীটনাশক দেশে নিষিদ্ধ হলেও চোরাই পথে এসব আসে অবাধে এবং ব্যবহার করা হয় বিপদের কথা না জেনে, না মেনে। জনবহুল দেশের চাহিদা মেটাতে শস্য নিবিড়তা ক্রমেই বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কীটনাশকের ব্যবহার। কৃষকদের প্রশিক্ষণের অপর্যাপ্ততা এবং অদক্ষতার কারণে ফসলে ব্যবহৃত কীটনাশকের বিষ মানবদেহে ঢুকে রক্তে মিশছে সহজেই।
দূষণ কমাতে একমত নয় দেশগুলো
আবার ফিরে আসি কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি সেক্রেটারিয়েটের হেড অব কমিউনিকেশন ডেভিড এইন্সওরর্থ কাছে। ডেভিডকে প্রশ্ন করি নেগোসিয়েশন মিটিং দূষণ কমানোর বিষয়ে দেশগুলো মতামত কী? ডেভিড জানান, ওয়ার্কিং গ্রুপে দেশগুলো প্রশ্ন রেখেছে সবনিম্ন কতটুকু দূষণ অ্যাকসেপ্ট করা যাবে তার মাত্রা নির্ধারণের বিষয়ে। কারণ, আমরা যখন কৃষিক্ষেত্রে ফারটিলাইজার ও কীটনাশকের দূষণের কথা বলবো এবং তখন এগুলো সঠিক মাত্রায় ব্যবহার বা এগুলো বন্ধ করার বিষয়ে আলোচনা করবো এবং ঠিক তখনই অটোমেটিক্যালি কৃষি উৎপাদনে খাদ্য নিরাপত্তায় এর প্রভাবের বিষয়টি সামনে চলে আসবে।
ডেভিড যুক্ত করেন, সাইন্স পেপারগুলো বলছে, নাইট্রোজেন, ফরফরাস ও কীটনাশকের ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা সম্ভব ফারটিলাইজার ও কীটনাশকের সঠিকমাত্রায় ব্যবহারের মাধ্যমে। শুধু তাই নয় ফার্টিলাইজার ও কীটনাশকের ব্যবহার সঠিক, যৌক্তক এবং কমমাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব খাদ্য নিরাপত্তাকে বেশি মাত্রায় পরিবর্তন না করেই। যদিও অনেক দেশ কৃষি উৎপাদনে ফারটিলাইজার ও কীটনাশক ব্যবহার না কমানোর বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করে এবং টার্গেট-৭ এ নতুন সম্ভাব্য দূষণ সংযুক্তির বিষয়ে নিজেদের ভিন্ন মত প্রকাশ করে নেগোশিয়েশনে।
জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ওয়ার্কিং গ্রুপ-৪ এর সভা রবিবার শেষ হবে এবং টার্গেট-৭ সহ গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্ক এর সমস্ত লক্ষ্য চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করা হবে। এই বছরের ডিসেম্বরে কানাডার মন্ট্রিলে করা হবে এর সর্বসম্মত গ্রহণ।
[This story was produced as part of a reporting fellowship to the 2022 UN Convention on Biological Diversity’s 4th Meeting of the Open-ended Working Group on the Post-2020 Global Biodiversity Framework, led by Internews’ Earth Journalism Network.]
/এডব্লিউ
Leave a reply