‘দেশহীন জাতি’ ও ‘বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠি’ রোহিঙ্গারা ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। একসাথে ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। বর্বরভাবে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা পুরুষকে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনারা। বাদ দেয়নি শিশুদেরকেও। নারীরা হয়েছেন ধর্ষিত। কয়েকশ গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ একে স্মরণকালের ভয়াবহ শরণার্থী সঙ্কট বলে অভিহিতি করেছে। একই সাথে বলেছে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন অভিযান চালাচ্ছে। অর্থাৎ, আরাকানের এই মুসলিম জনগোষ্ঠিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় সুচি সরকার।
কিন্তু এই চরম সঙ্কটের মুহূর্তে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোকে সেভাবে পাশে পায়নি রোহিঙ্গারা এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের চলমান অধিবেশনেও নিপীড়ণকারী মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মুসলমি দেশগুলোর শক্ত কোনো অবস্থান চোখে পড়ছে না। অথচ, ৭০ এর দশকে প্রথম বড় আকারে যখন রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করা হয়েছিল, তখন ২ লাখের বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল সৌদি আরব। অতীতে রোহিঙ্গাদের পক্ষে সরব ছিল পাকিস্তানও। দেশটিতে বর্তমানে দেড় লাখের বেশি এই জনগোষ্ঠির মানুষ বাস করছেন।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের বর্তমান পর্যায়ে তুরস্কের কথা বাদ দিলে শুধু নিন্দা জানানোর মধ্যেই নিজেদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে মুসলিম দেশগুলো। কিন্তু এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ কী? বার্তা সংস্থা এপি বলছে, ব্যবসায়িক স্বার্থই প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে রোহিঙ্গাদের পক্ষে সক্রিয় হওয়া থেকে বিরত রাখছে।
গভীর সমুদ্র উপকূলে মিয়ানমারের অবস্থান। দেশটির আরাকান প্রদেশ হয়ে মধ্যপ্রাচ্য-ককেশাস ও চীনকে সংযুক্ত করেছে তেল সরবরাহের একটি পাইপলাইন। এই পাইপলাইন দিয়ে চীন তার ইউনান প্রদেশে তেল আমদানি করে থাকে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই লাইন দিয়ে চীনে তেল রফতানি করতে চায়। এ বিষয়ে দুই বছর আগে বেইজিং-রিয়াদ চুক্তিও করে রেখেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সৌদি সরকার মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে চাইলে চীনের সাথে এই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া শঙ্কা আছে। আবার পাইপলাইনের পুরো নিরাপত্তার দায়িত্ব মিয়ানমারের। নেইপিদো এটির নিরাপত্তা বিধান না করলে বিপাকে পড়বে রফতানিকারকরা।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সাথে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে মিয়ানমারের। চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি আছে মিয়ানমারের। এর পরবর্তি প্রজন্মের যুদ্ধবিমান কিনতেও আগ্রহী নেইপিদো। এছাড়া সামরিক ক্ষেত্রে চীন-পাকিস্তান-মিয়ানমারের পরস্পপরের মধ্যে বেশ কিছু সহযোগিতা প্রকল্প রয়েছে। ফলে ইসলামাবাদ জোরালোভাবে মিয়ানমারের বিপক্ষে দাঁড়াতে চাইবে না।
ইরানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভারতের সাথে বাণিজ্যিক ও সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে দেশটি। চীনের সাথেও উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে তেহরানের। ফলে চীন ও ভারত যখন মিয়ানমার সরকারের পক্ষে অবস্থান নেবে তখন ইরান এর বিপরীতে জোরালোভাবে দাঁড়াবে না।
বিষয়টা এমন দাড়িয়েছে, মানবতার তাগিদ কিংবা একই ধর্মের মানুষের পাশে দাড়ানোর চেয়ে দেশগুলো প্রাধান্য দিচ্ছে বাণিজ্যিক স্বার্থকে। তবে রোহিঙ্গাদের পক্ষে খুব জোরালো কিছু করতে না চাওয়ার বিষয়টা ‘পুষিয়ে দিতে’ মুসলিম দেশগুলো কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রচুর পরিমাণ ত্রাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। যার মধ্যে কিছু ত্রাণ এরিমধ্যে এসে পৌঁছেছেও।
/কিউএস
Leave a reply