৩০ বছর পর সবার জন্য উন্মুক্ত হলো চাকিরপশার ১৪১ একর

|

ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘ ৩০ বছর পর সবার জন্য উন্মুক্ত হলো চাকিরপশার নদীর ১৪১ একর। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ৩০ বছর পর রক্ষা পেলেন নদীপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত জেলেসহ শত শত মানুষ। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেছিল যমুনা টেলিভিশনের অনুসন্ধানী দল টিম ৩৬০ ডিগ্রি। এখন এই নদীর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যা নিশ্চিত করাসহ পানিপ্রবাহ বাধামুক্ত ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ করার দাবি নদীরক্ষা বিষয়ক সংগঠনগুলোর।

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলা এবং উলিপুর উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত শত বছরের পুরনো একটি পানির প্রবাহ আছে। স্থান বিশেষে এর কয়েকটি নাম। রাজারহাট সদর ইউনিয়নের ইটাকুড়ি থেকে উৎপন্ন হয়ে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে এসে এর নাম চাকিরপশার, আরও কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে এর নাম মরা তিস্তা এবং ভাটিতে এর নাম বুড়িতিস্তা।

আশির দশকে রাজারহাটের পাঠানহাট নামক স্থানে চাকিরপশারে আড়াআড়া সেতুবিহীন সড়ক নির্মাণ করে এই প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হয়। প্রবাহ বন্ধ হলে এটাকে বদ্ধ বিল হিসেবে নব্বই এর দশকে বন্দোবস্ত দেয়া শুরু হয়। জেলা প্রশাসনের সূত্র মতে, এই বদ্ধ বিলের (কার্যত উন্মুক্ত নদী) আয়তন ৩০৬ একর। এর ১৪১ একর অমৎস্যজীবীদের কাছে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছিল। বাকিটুকুর প্রায় সম্পূর্ণটাই বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে যোগসাজসে অবৈধভাবে লিখে দেয়া হয়েছে। আড়াআড়ি সেতুবিহীন সড়ক নির্মাণ করার কারণে হাজার হাজার একর ধানের জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ফলে তেফসলি জমিও হয়ে উঠেছে এক ফসলি। কোনো কোনো বছর একবারও ফসল পাওয়া যায় না।

জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, নদীর পানি বাধাহীন করার দাবিতে, অমৎস্যজীবীদের বন্দোবস্ত বাতিল এবং অবৈধ দখল মুক্ত করার দাবিতে কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে রিভারাইন পিপলের চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটি এবং গণকমিটি। কয়েকটি দাবির মধ্যে একটি দাবির প্রতি সরকারি সিদ্ধান্ত মিলেছে। সেটি হলো, বন্দোবস্ত বাতিল।

জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার প্রস্তুতকৃত চলতি বছরের মে মাসের কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার বিলের ১৪২৯ বাংলা সনের বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়েছে। বিবরণী সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির দেয়া অভিযোগের ভিত্তিতে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষে অনুসন্ধান চালানো হয়। এতে রাজারহাট উপজেলা প্রশাসন এবং উপজেলা মৎস্য বিভাগের সহযোগিতা নেয়া হয়।

কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, ‘চাকিরপশার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ’ যেভাবে নিবন্ধিত হয়েছে সেই প্রক্রিয়া যথাযথ হয়নি। ওই সমিতিতে ২০জন সদস্যের কথা বলা হয়েছে। জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে ওই ২০ জনের মধ্যে ৪জন কৃষক, ৪জন দিনমজুর, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ১জন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ১জন, পল্লী চিকিৎসক ১জন, ঢাকায় থাকেন ৩জন, কাঠমিস্ত্রি ১জন, ঠেলাগাড়ি চালক ১জন, ব্যবাসায়ী ৩জন। একজনকে মৎস্যজীবী উল্লেখ করা হলেও পরেই আবার বলা হয়েছে প্রকৃত মৎস্যজীবী একজনও নেই।

সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর ২(খ) ধারার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে ওই সমিতির বন্দোবস্ত পাওয়ার সুযোগ নেই। ওই কার্যবিবরণীতে নেয়া সিদ্ধান্তের শেষাংশ ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাজারহাট, কুড়িগ্রাম ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাজারহাট, কুড়িগ্রাম এর তদন্ত প্রতিবেদন মোতাবেক ইজারা গ্রহীতা চাকিরপশা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ রাজারহাট, কুড়িগ্রাম এর সমিতির কাগজপত্রে ত্রুটি থাকায় এবং সংশ্লিষ্ট সমিতির সদস্যরা প্রকৃত মৎস্যজীবী নন সেহেতু চাকিরপশার বিল (বদ্ধ) জলমহালটির চাকিরপশার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ, রাজারহাট, কুড়িগ্রাম এর ১৪২৯ বাংলা সনের ইজারা বাতিল করা হলো।

২০২০ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভিনকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে চাকিরপশার বন্দোবস্ত দেয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা জারি করলেও তিনি তা পালন করেননি। বর্তমান জেলাপ্রশাসক চাকিরপশারের ১৪১ একর বন্দোবস্ত বাতিল করায় আন্দোলনকারী সংগঠন রিভারাইন পিপলরের চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটি এবং গণকমিটির পক্ষে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়।

এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, হাজার হাজার জেলে চাকিরপশারে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। বন্দোবস্ত থাকাকালীন এসব মৎস্যজীবীরা নদীতে নামতেও পারতেন না। এখন সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চাকিরপশারে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সরেজমিন তদন্ত করে রাজারহাটের ইটাকুড়ি থেকে তিস্তায় মিলনস্থল পর্যন্ত স্রোত বাধাহীন করার সুপারিশ করেছে। একই সাথে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, সেতুবিহীন সড়কে সেতু স্থাপন, ছোট সেতুগুলো ভেঙে সেতু বড়করণ এবং স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত বাতিলেরও সুপারিশ করেছে। এখন পানির প্রবাহ বাধাহীন এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে। এর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যাও করতে হবে। চাকিরপশাকে রংপুরে বিভাগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

এ ব্যাপারে রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সরেজমিন তদন্ত করে রাজারহাটের ইটাকুড়ি থেকে তিস্তায় মিলনস্থল পর্যন্ত স্রোত বাধাহীন করার সুপারিশ করেছিল। একই সাথে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, সেতুবিহীন সড়কে সেতু স্থাপন, ছোট সেতুগুলো ভেঙে সেতু বড়করণ এবং স্থায়ীভাবে লিজ বাতিলেরও সুপারিশ করেছিল। 

তিনি আরও বলেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চাকিরপশার সুরক্ষায় ছয়বার চিঠি দিয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ও একবার চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে চাকিরপশার লিজ দেয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা জারি করলেও তিনি তা পালন করেননি। পরবর্তীতে বাংলাদেশি আইনজীবী ও পরিবেশকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান রিট করেন। পরে বর্তমান জেলা প্রশাসন চাকিরপশার ১৪১ একর বন্দোবস্ত বাতিল করেছেন।

রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ যমুনা টেলিভিশনের অনুসন্ধানী দল টিম ৩৬০ ডিগ্রিকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

দীর্ঘ আন্দোলন ও দাবির প্রেক্ষিতে চাকিপশার মুক্ত হওয়ায় আন্দোলনকারী সবার পক্ষে জেলা প্রশাসনের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এই তিনি বলেন, এখন চাকিরপশার পানির প্রবাহ বাধাহীন এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে। এর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যাও করতে হবে।

/এনএএস


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply