টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
ইফতারের বাকি মাত্র ২০ মিনিট। এরই মধ্যে টাঙ্গাইল শহরের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে দুটি টেবিলে সাজানো ইফতারের পসরা। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। পাশেই ব্যানারে লেখা রয়েছে ‘মাসব্যাপী সবার জন্য ইফতার।’ ইফতারের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে অসহায় গরিব মানুষ কিংবা পথচারী সবাই এখান থেকে বিনামূল্যে ইফতারি সংগ্রহ করছেন। মাগরিবের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রীতিমতো ভিড় লেগে গেল। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন এখান থেকে বিনামূল্য ইফতারি সংগ্রহ করলেন। ইফতারে মুড়ি, খেজুর, পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ, মুড়ি, জিলাপি, শসা, শরবতসহ বেশ কয়েকটি আইটেম থাকছে। সপ্তাহে দুইদিন খিচুির-মাংসও দেয়া হয়।
রমজান মাসে অনেকেই অসহায়, গরিব ও দুস্থ মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে। তবে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে ত্রিবেণী টাঙ্গাইল এবং বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় ব্যাচ ১৯৯২। তারা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী উন্মুক্ত ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে। এ নিয়ে তৃতীয় বারের মতো তারা এই ধরণের আয়োজন। প্রতিদিন প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জনের মতো রোজাদার এখানে ইফতার করেন। এতে প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়। সংগঠনের নিজস্ব তহবিল থেকে এ খরচ করা হয়।
সরেজমিনে আছরের নামাজের পর দেখা যায়, ইফতার করার জন্য সারিবদ্ধভাবে লোকজন বসে আছেন। অনেকেই স্কুল-ছাত্র, কেউ ব্যবসায়ী, আবার অনেকেই ভ্যানচালক, রিকশাচালক, পথচারী, ভিক্ষুক, অসহায় এবং দরিদ্র শ্রেণির মানুষ।
৬০ বছরের এক বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম। তার স্বামী চলতি বছর মারা যায়। এরপর থেকেই তিনি সংসারের ব্যয়ভার বহন করছেন। শহীদ মিনারে উন্মুক্ত ইফতার মাহফিলে তার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে বিনামূল্যে প্রায়ই ইফতার করে থাকি। আমার স্বামী নাই, তাই আমি টোকাইয়ের কাজ করে থাকি। আমাগোর নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই। আমরা যেখানে সেখানে কাজ করে থাকি। আমি দোয়া করি তারা যেন ভবিষ্যতে আরো বড় কোন কল্যাণমূলক কাজ করতে পারে।
এ বিষয়ে কথা হয় অহনা বেগম নামে এক ভিক্ষুকের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমি বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করে খাই। আমি খুব গরীব মানুষ। দু’বেলা দুমুঠো খেতে পারি না। এক বেলা খাবার জুটলে আরেক বেলা জুটে না। আমি উন্মুক্ত ইফতার মাহফিলে রোজার প্রথম দিন থেকেই ইফতার করছি। আমাদের মতো অনেক অসহায় এবং গরীব লোক এখানে ইফতার করে থাকে। আমাদের মতো অসহায় এবং গরীব লোক লোকদের জন্য এমন আয়োজন সত্যিই প্রশংসনীয়।’
সেখানে ইফতার করার সময় কথা হয় ভ্যান চালক মো. করিমের সাথে। করিম বলেন, ‘আমি শহরের ভ্যান চালাই। ভ্যান চালিয়ে আমার কোন মতে সংসার চলে। এ অবস্থায় আমার ইফতার কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ নেই। আমি ইফতার করার জন্য বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। শহীদ মিনারে উন্মুক্ত ইফতার মাহফিল দেখে আমি এখানে আসলাম এবং ইফতারও করলাম।’
কথা হয় এক পথচারীর সাথে, তিনি বলেন, ‘আজ আমি এখানে ইফতার করেছি। তাদের এ উদ্যোগে কে আমি স্বাগত জানাচ্ছি। আমার মতো অনেক পথচারীও এখানে ইফতার করেছেন। তবে এখানে গরীব এবং দুস্থ লোকজনের সংখ্যা বেশি।’
কর্মচারী জাহাঙ্গীর আলম জানায়, ‘আমরা এখানে ৭ থেকে ৮ জন কর্মচারী কাজ করছি। বিনামূল্যে ইফতার খাওয়ানোর কাজ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান এবং ধন্য বলে মনে করি। এখানে ধনী-গরিব সব শ্রেণির লোকই ইফতার করেন। রোজাদারদের জন্য রয়েছে বহু আইটেমের ইফতার সামগ্রী।’
এ ব্যাপারে ত্রিবেণীর অর্থ সম্পাদক এবং যমুনা টেলিভিশনের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি শামীম আল মামুন বলেন, অনেকেই আছে ইফতার করতে পারবেন না দেখে এই ভয়ে রোজা রাখেন না। আবার কেউ কেউ আছেন রোজা রেখে ভালো ইফতার করতে পারেন না। অন্যদিকে পথচারী রয়েছে যারা কাজের জন্য রাস্তায় আটকে যান তারাও সময় মতো ইফতার করতে পারেন না। এসব পরিস্থিতি চিন্তা করে আমরা বিনামূল্যে গরিব ও অসহায় থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত ইফতারের উদ্যোগ নিয়েছি। এতে প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়। এই টাকা আমরা নিজেরাই বহন করি। আমাদের সংগঠনের প্রতিটি সদস্যই অর্থের যোগান দেন।
এ ব্যাপারে ত্রিবেণীর সভাপতি মমিনুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, প্রথমে ২০১৬ সালে আমরা ত্রিবেণীর উদ্যোগে এই ধরণের আয়োজন করেছিলাম। পরের বছর ২০১৭ সালে বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় ব্যাচ ১৯৯২ আমাদের সাথে যুক্ত হয়। এর পর থেকে আমরা এই দুই সংগঠন মিলে বিনামূল্যে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে আসছি। এবছরও আমরা বিনামূল্যে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছি এবং এ সংগঠন যতদিন বেচে থাকবে আমরা এমন আয়োজন প্রতিবছরই করে যাবো।
Leave a reply