সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাণ। ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে এই ব-দ্বীপ অঞ্চল রক্ষার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ। শ্বাপদসংকুল এ অরণ্যের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে লাখ লাখ মানুষ। নিরন্তর সংগ্রাম করে চলা এই বনজীবীদের কাছে আতঙ্কের নাম একেকটি দস্যুবাহিনী। সুখের কথা, এই দস্যুবাহিনীগুলো একে একে আত্মসমর্পণ করছে, আইনের কাছে নিজেদের সোপর্দ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। আর এই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটিতে মধ্যস্থতা করেছেন একজন সাংবাদিক। তিনি মোহসীন-উল হাকিম। ধারাবাহিকভাবে লেখছেন তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প। যমুনা অনলাইনের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
জীবনে ফেরার গল্প (১৬-তম কিস্তি)
দস্যুদের কেউ তাকে ডাকে হান্নান স্যার, কেউ আরমান স্যার, কেউ বা আদনান স্যার। যে নামেই ডাকুক সেই ব্যক্তির নাম আদনান কবীর। র্যাব-৮’র উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবীর। ২০১৬ সালের শুরু থেকে যখন সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণের কাজে গতি এলো, তখন থেকেই বরিশাল র্যাবের সে সময়ের উপ-অধিনায়কের সঙ্গে যুগপৎ কাজের শুরু। সুন্দরবন আর উপকূলের জেলে-বাওয়ালী, ট্রলার মালিক, শ্রমিক, মাঝিদের মনের ভেতরে এই নামটি গেঁথে গেছে।
অন্যদিকে, সুন্দরবনের দস্যু দমনে তার নেতৃত্বে চলছিল অভিযান। সুচিন্তিত আর গোছানো সেই অভিযানের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা না গেলেও, দস্যুরা যে কোণঠাসা হচ্ছে তা আমি ঠিকই অনুভব করছিলাম।
২০১৫ সালের শেষ দিকের কথা। সুন্দরবনের মাস্টার বাহিনী তখন আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। যমুনা টিভির মাধ্যমে সেই আবেদন জানায় তারা। প্রথমে সেই আবেদন পৌঁছে দেই মোংলার কোস্টগার্ডের জোনাল কমান্ডারের কাছে। তেমন সাড়া না পেয়ে আত্মসমর্পণের সেই আবেদন নিয়ে যাই র্যাব-৬ অর্থাৎ খুলনা র্যাবের কাছে। সেখানেও সাড়া মিললো না।
এরই মধ্যে, র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আজাদ (পরবর্তীতে সিলেটে জঙ্গিদের বোমা বিস্ফোরণে শহীদ) আমাকে ফোন করে কাজ চালিয়ে নেয়ার কথা বলেন। পরদিনই বরিশাল র্যাবের উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবীরের ফোন পাই।
বিডিআর মিউটিনির পর বিজিবি মহাপরিচালকের এডিসি যখন, তখন থেকেই মেজর আদনান এর সঙ্গে আমার পরিচয়। এছাড়া ক্যাডেট কলেজের ভাই হিসেবে মুহূর্তেই আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে যায়। তারপর একসঙ্গে পথ চলা শুরু।
জঙ্গলের দস্যুদল মাস্টার বাহিনীর সঙ্গে দু’জনে মিলে কথা বলতে থাকি। প্রথমে র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণে অনীহা থাকলেও পরবর্তীতে রাজি হয় তারা। আমি বুঝিয়েছি, পাশাপাশি মেজর আদনানের সঙ্গেও কথা বলে আশ্বস্ত হয় সে সময়ের সবচেয়ে বড় দস্যু বাহিনীটির সদস্যরা। আর আগে থেকেই আমার প্রতি শতভাগ আস্থা ছিল তাদের। এর সঙ্গে মেজর আদনান সহ র্যাবের সংশ্লিষ্ট সিনিয়র কর্মকর্তাদের উপযুক্ত ভূমিকাই আত্মসমর্পণের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল।
২০১৬ সালের এপ্রিলে দ্বিতীয় দফা যাই মাস্টার বাহিনীর কাছে। ক্যামেরায় আবারও আত্মসমর্পণের আবেদন জানায় তারা। একই সঙ্গে লিখিত আবেদনও করে। সুন্দরবন থেকে ফিরে সেই আবেদনপত্র পৌঁছে দিয়েছিলাম আদনানের হাতে।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত তারিখ ঠিক হয়। কথা ছিল জুন মাসের ৩ বা ৪ তারিখে তারা উঠে আসবে। বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাই। এরই মধ্যে র্যাব মহাপরিচালকও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের তারিখ দেন ২৯ মে। অস্ত্রসমর্পণ হবে মোংলার ফুয়েল জেটিতে।
সেই অনুযায়ী মাস্টার বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে ২৬ মে আমরা ঢাকা থেকে রওনা দেই। সেই রাতেই মোংলা থেকে নেমে পৌঁছে যাই তাদের কাছে।
২৮ তারিখ নির্ধারিত সময়ে দস্যুদের নিয়ে মেজর আদনানের নেতৃত্বে আসা র্যাবের হেফাজতে যায় মাস্টার বাহিনী। তারা জমা দিয়েছিল ৫২টি অস্ত্র ও সাড়ে ৫ হাজার গুলি। অনেকে ভাবতে পারেন এই গল্প তো আগেই শুনেছি। তারপরও গল্পটি আবার লিখলাম। কারণ, সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যু বাহিনী তখনও বনের ভেতরেই আছে।
আমরা গিয়ে তাদের নিয়ে আসব, সেই কথার ওপরেই র্যাব মহাপরিচালক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে আসার কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়েছে। এত বড় ঝুঁকি সবাই নিজের ঘাড়ে নিতে পারে না। নিজের ওপর বিশ্বাস ও এর পাশাপাশি আদনান আমার ওপর ভরসা রেখেছিলেন বলেই শেষ পর্যন্ত দস্যুদের আত্মসমর্পন শুরু হয়। অবশ্য র্যাবের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও মেজর আদনানের ওপর ভরসা রেখেছিলেন। আসলে তিনি ভরসা করার মতোই একজন কর্মকর্তা।
আত্মসমর্পণের ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। আর এর প্রভাব জানতে হলে যে কেউ সুন্দরবন ও উপকূলের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।
মাস্টার বাহিনীর পরে ইলিয়াস ও মজনু বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। মেজর আদনানের তত্ত্বাবধানে এর পরে আত্মসমর্পণ করে শান্ত বাহিনী, আলম বাহিনী, খোকাবাবু বাহিনী, সাগর বাহিনী, নোয়া বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী, ছোট রাজু বাহিনী, কবিরাজ বাহিনী ও দুর্ধর্ষ আলিফ বাহিনী।
এক একটি দস্যু বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করাতে আমাদের দুজনকেই অনেক কাজ করতে হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে তাদের আস্থা অর্জন করতে হয়েছে। সমন্বিত একটি কাজ যে সফল হয়, তার প্রমাণ এই আত্মসমর্পণ।
একবার বেশ কয়েকটি অস্ত্র ও অনেকগুলো গুলি নিয়ে সাগরে দস্যুতার পরিকল্পনা করছিল একটি দস্যু দল। অস্ত্রগুলো রাখা ছিল পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর চর মন্তাজের কোনো একটি বনের ভেতরে। খবর পেয়ে মেজর আদনানকে জানিয়েছিলাম সন্ধ্যার দিকে। তাৎক্ষণিকভাবে টিম পাঠিয়ে সেই অস্ত্র গুলিসহ দুজনকে আটক করে র্যাব। সাগরে অবধারিত একটি দস্যুতা থেকে বেঁচে যায় অনেক জেলে। সেই থেকে পটুয়াখালীর খোকন মাঝির নেতৃত্বে সাগরে দস্যুতা বন্ধ।
আবার কখনও খবর এসেছে, জাহাঙ্গীর বাহিনী সাগরে নামবে আজ রাতেই। সুন্দরবনের ছাপড়াখালী থেকে রাতেই সাগরে দস্যুতা করবে তারা। খবর পাওয়া মাত্র তাদের ধরতে যাওয়ার মত বাস্তবতা ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ট্রলার মালিকদের জানিয়ে দেন। সম্ভাব্য দস্যুতার খবর পৌঁছে যায় সাগরে। জেলেরা ট্রলার নিয়ে নিরাপদ এলাকায় সরে যায়।
কোনো একজন বনদস্যুর নাম যখন বলেছি তার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে সেই দস্যুর পুরো নাম, বাবার নাম, বাড়ির ঠিকানা, কবে কোন বাহিনীর সঙ্গে দস্যুতা করেছে সবকিছু অনর্গল বলে ফেলতে পারতেন মেজর আদনান। বরিশালে বসে সুন্দরবনসহ উপকূলের খুঁটিনাটি খবর পর্যন্ত পৌঁছে যেতো তার কাছে। এর প্রমাণ অনেকবার পেয়েছি।
দস্যুতা নির্মূলে উপকূলজুড়ে জানা অজানা অনেক কাজ করেছেন তিনি। যা উপকূলের মানুষদের রক্ষা করেছে নানাভাবে। তাই উপকূলের মানুষ এই মেজর সাহেবকে চিনেন মহান এক ব্যক্তি হিসেবে।
তাদের অনেকেই এখনও মনে করেন, র্যাবের অফিসার মানেই মেজর আদনান। আমাকে এখনও অনেকে ফোন করে বলেন, বরিশালের আদনান স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। অর্থাৎ সেই অফিসিয়াল ফোনে যিনিই থাকুন, অনেকেই মেজর আদনান মনে করেই এখনও কথা বলেন। একেকজন তাকে একেক নামে ডাকেন। যেই নামেই ডাকুক, র্যাবের এই সাবেক কর্মকর্তার নাম এখনও সবার মুখে মুখে।
পুরো কাজে অসংখ্য ভাল-মন্দ অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের। মজার অভিজ্ঞতাও ছিল অনেক। জীবনে ফিরে আসা দস্যুদের আবারও সমাজে ফিরিয়ে দিতে মনোযোগী ছিলেন তিনি। এক কথায় সুন্দরবন উপকূলের মানুষদের সমস্যার গভীরে ঢুকতে পেরেছিলেন তিনি। আর সেই কাজে তিনি ব্যাটেলিয়ন অধিনায়কের সমর্থন পেয়েছিলেন। পেয়েছেন হেড কোয়ার্টারের কর্মকর্তাদের সমর্থন।
পুরো কাজে পেছন থেকে আমাকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন আদনান। কখনও ধন্যবাদ দিয়েছেন, আবার কখনও আমার ভুলের জন্য বকাঝকাও করেছেন।
যাই হোক, নিয়ম অনুযায়ী বদলী হয়ে আদনান ফিরে গেছেন মূল চাকরি সেনাবাহিনীতে। তার স্থলাভিষিক্ত কর্মকর্তারাও নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রেখে চলছেন। সুন্দরবন হয়তো দস্যুমুক্ত হবে। একদিনের জন্য হলেও তা হবে।
সুন্দরবন ও উপকূলের জেলে বাওয়ালীদের পক্ষ থেকে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা…
(নোট: প্রায় দুই বছরব্যাপী আত্মসমর্পণের কাজ চলাকালে আমাদের অনেক মজার মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যদি বই লিখতে পারি, সেখানে সেই গল্পগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব…)
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন।
যমুনা অনলাইন: এমএইচ/টিএফ
আরও দেখুন:
জীবনে ফেরার গল্প: জেলে নৌকার সহকারী থেকে দস্যুনেতা
Leave a reply