ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
ঠাকুরগাঁওয়ে চলতি রমজানের শুরু থেকেই সদর উপজেলাসহ চার উপজেলায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে লোডশেডিংয়ের মাত্রা। গরমের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। এতে ব্যহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা। দিনে ও রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় বিশেষ করে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ রোজাদার মানুষ পড়েছে চরম ভোগান্তিতে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি মূলগ্রিড থেকে সরবরাহ না থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
গত দুদিন ধরে দিনে ১৫ থেকে ২০ বার দেয়া হচ্ছে লোডশেডিং। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টাই থাকছে না বিদ্যুৎ সরবরাহ। সাধারণ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ প্রতিবছর রমজান শুরু হলেই বাড়ে লোডশেডিং। এবার গত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, দেশে অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে যা বিভিন্ন মিডিয়ায় শোনা যাচ্ছে। তাহলে এতো বিদ্যুৎ যাচ্ছে কোথায় ?
সদর উপজেলা পৌর শহরের হাওলাদার সুপার মার্কেটের বধুয়া বস্ত্র বিতানের মালিক পলাশ জানান, তিনি ঈদ উপলক্ষে প্রায় আশিলক্ষ টাকার কাপড় উঠিয়েছেন। কিন্তু দিনে রাতে প্রায় দশ থেকে পনের বার বিদ্যুতের লোডশেডিং এর কারণে তেমন একটা বেচা বিক্রি নেই বললেই চলে। বিশেষ করে শহরের লোকজন দিনের বেলায় তেমন একটা কেনাকাটা করেন না। তাই সন্ধ্যার পর তারা ঈদের কেনাকাটা করতে বের হয়। আর ঠিক সেই সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। এতে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
নর্থ সার্কুলার রোডের চায়না ক্লথ স্টোরের ম্যানেজার জাকির হোসেন স্বপন বলেন, গত রমজানের চেয়ে এ বছর অনেক বেশি লোডশেডিং বেড়ে গিয়েছে। রমজানে ক্রেতাদের ভিড় স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে যায়। এবছর এই রমজানে এমনিতেই মাত্রারিক্ত গরম পড়েছে, আর তার উপর ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে যে হারে বিক্রি হওয়ার কথা সে হারে বিক্রি হচ্ছেনা।
একই এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী মনোজ আগারওয়ালা বলেন, তিনি সহ অন্যান্য ব্যবসায়ীরা এই রমজান মাসের জন্য অপেক্ষা করে। কারণ এই রমজানে সবথেকে বেশি বেচাকেনা হয়। কিন্তু দু:খের বিষয় এই রমজানেই সব থেকে বেশি লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে।
সদর উপজেলা পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকার রেডিমেট কাপড় ব্যবসায়ী নূরুল ইসলাম দেওয়ান জানান, এই রমাজানে যে হারে লোডশেডিং শুরু হয়েছে তাতে এবছর ব্যবসা করে মূলধন উঠানোই মুশকিল হয়ে উঠবে। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন মিডিয়ায় শোনা যাচ্ছে এবছর যে হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে তা সর্বোচ্চ রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। এতো বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও কেন এতো ঘন ঘন লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। তাহলে দেশের উৎপাদিত বিদ্যুৎ কোথায় যাচ্ছে ?
শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌরাস্তা এলাকার আভা সুজ এর মালিক জুনায়েদ কবির বাবু বলেন, রমজান আসলেই প্রতিবছর লোডশেডিং বেড়ে যায়। সন্ধ্যার পর যখন ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিং দেয়া হয় তখন ক্রেতারাও বিরক্ত হয়ে উঠে দোকান থেকে বের হয়ে যান।
শহরের বড় টেইলার ব্যবসায়ী নিপুণ টেইলার্সের মালিক সিপন সরকার জানান, এই ঈদকে কেন্দ্র করেই সারা বছরের লোকসান উঠিয়ে নেন তিনি সহ অন্যান্য টেইলার মালিকরা। শহরে প্রায় পঞ্চাশটির মতো টেইলার্স এর দোকান রয়েছে। আর প্রত্যেকটি টেইলার্সের আওতায় প্রায় বিশ ত্রিশজন করে কারিগড় কাজ করে। ঈদ উপলক্ষে রমজানের শুরু থেকে সকল বয়সের মানুষ, বিশেষ করে মহিলা কাষ্টমাররা তাদের পছন্দের বিভিন্ন ডিজাইনের কাপড় সেলাই করতে দেন। কিন্তু বিদ্যুত না থাকার কারণে কারিগড়রা তাদের কাজ ঠিকমতো উঠাতে পারছেন না।
নিপূণ টেইলার্সের কারিগড় দুলাল চন্দ্র রায় বলেন, যেখানে গড়ে প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বারো থেকে পনেরটি কাপড় তিনি ডেলিভারি দিয়ে থাকেন সেখানে এই লোডশেডিংয়ের কারণে সকাল দশটা থেকে রাত বারোটা একটা পর্যন্ত কাজ করেও পাঁচটি কাজ ডেলিভারি দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
এদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে শুধু ব্যবসায়ীরাই নন, সাধারণ রোজাদার মানুষও পড়েছে চরম ভোগান্তিতে। শহরের আশ্রম পাড়ার বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন জানান, সারা দিনে বেশ কয়েকবার লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে সারা দিন রোজা রাখার পর যখন স্বপরিবারে ইফতার করতে বসেন ঠিক সেই সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। এতে রোজাদার মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ করে বলেন অন্তত ইফতার ও তারাবি নামাজের সময় যেন বিদ্যুৎ না যায়। একই কথা জানান সে এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম সোহেল রানা ও রেবেকা সুলতানা সহ আরো অনেকে।
হলপাড়া এলাকার বাসিন্দা মেহবুবা শারমিন জানান, বর্তমানে যে হারে গরম বেড়েছে তা সহ্য করাই খুব কঠিন হয়ে পরেছে। তার উপর বারবার লোডশেডিং আরও বিরক্তকর ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে হাইপ্রেশার ও ডায়বেটিস এর মেতো রোগিদের ক্ষেত্রে তা কতটা যন্ত্রণাদায়ক সেটা যিনি ভুক্তভোগী তিনি ছাড়া অন্য কেউ বুঝবেননা।
এদিকে লোডশেডিং বন্ধে রমজানের প্রথম থেকে শুরু করে বর্তমানেও বারবার অনুরোধ ও অভিযোগ করেও কোন লাভ হয়নি বলে জানালেন ঠাকুরগাঁও জেলা ব্যাবসায়ি কল্যাণ সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক মামুনর রশিদ মামুন। তিনি বলেন, শুধু ব্যবসায়ী সংগঠন নয় চেম্বার অব কমাসের্র পক্ষ থেকেও এব্যাপারে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু কি কারণে লোডশেডিং দিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি ও ব্যবসার ক্ষতি করা হচ্ছে তা বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারাই জানেন।
এব্যাপারে ঠাকুরগাঁও জেলা বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অরুনাংশু চন্দ্র সেনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, মূলগ্রিড থেকে পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখানে তার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের কিছুই করবার নেই। তিনি আরও জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ এখন লোডশেডিং মুক্ত দেশ। জেলায় যতটুকু চাহিদা তা সম্পূর্ণই পাওয়া হচ্ছে। চাহিদার এখানে কোন কমতি নেই। তবে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারের কারণে শহরের যেখানে সেখানে মাঝে মধ্যে ট্রান্সফর্মার মেইন তার জ্বলে যাচ্ছে অথবা তারে আগুন লাগছে। এর কারণে সামান্য কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখা হয়। তবে ইফতার ও তারাবি নামাজের সময় লোডশেডিং না দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে ।
জেলায় পল্লী বিদ্যুতের ১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৪০০ গ্রাহকের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে খরচ হয় ৩৭ মেগাওয়াট এবং পৌর শহরে বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের প্রায় ২৯ হাজার গ্রাহকের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে প্রতিদিন খরচ হয় ১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ । যা মূল গ্রিড থেকে সরবরাহ হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের পরও এমন কেন এতো ঘন ঘন লোডশেডিং প্রশ্ন সাধারণ মানুষের।
এব্যাপারে জেলা প্রশাসক আখতারুজ্জামান বলেন, এই রমজানে জনস্বার্থে লোডশেডিং বন্ধের বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারে সাথে আলোচনা করে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হবে।
Leave a reply