ক’দিন আগে তথ্য প্রযুক্তি আইনে কারাগারে যেতে হয়েছিল সংগীতশিল্পী আসিফ আকবরকে। এখন তিনি জামিনে মুক্ত আছেন। ফেসবুকে জানাচ্ছেন, কারাগারের অভিজ্ঞতার কথা। এর আগে, কারাগারে প্রবেশের প্রাথমিক অনুভূতির কথা লিখেছেন। এবার আসিফ জানাচ্ছেন সেখানকার খাদ্যাভ্যাসের কথা। লিখেছেন, ‘দু’টুকরো মুরগীর মাংস আর ভাত দেয়া হলো খাবারে । ভুনা মাংসে ঝোল নেই,আমি আবার শুকনো খাবার খেতে পারি না । শাওন’কে ডালের কথা বলবো কিভাবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না । পরে কাঁচা লবন চেয়ে নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। প্রতি লোকমা ভাত চিবিয়ে যাচ্ছি অনন্তকাল, গিলতেই পারছি না। হঠাৎ করে মনে হল পানি তো আছে। লজ্জায় ঠান্ডা পানিও চাইতে পারছিলাম না। পরে পানি দিয়ে গপাগপ খেয়ে ফেললাম। মাংসের প্রতিটি অংশই অনেক Expensive (দামি) মনে হচ্ছিলো।’
কারাগারে অন্য কয়েদিদের কাছে থেকে যে আন্তরিকতা পেয়েছেন উল্লেখ করেছেন সে কথাও, ‘সর্বকনিষ্ঠ বন্দী মাহবুব নিয়ে এলো হ্যান্ড-ওয়াস । এদিকে পাঞ্জাবী আর প্যান্ট ও ধোয়া দরকার, ভাবলাম পানিতে ভিজিয়ে রাখি পরে ধুয়ে নিবো। ছোট মাহবুব তা হতে দিলোনা, সে কাপড়গুলো ধুয়ে ফেললো। এবার আর শরীর চলে না। খাওয়ার পর অনন্ত বিশ মিনিট হাঁটি, সেটা আর সম্ভব হল না ,পড়ে গেলাম বিছানায়, শরীর জুড়ে ক্লান্তি আর ক্লান্তি।’
কয়েদি জীবনের আরও কিছু দিক উঠে এসেছে এই শিল্পীর বর্ণনায়। যেমন মাথার বালিশের কথাই ধরা যাক। ‘বালিশটা প্রথমে বানানো হয়েছিল শিমুল তুলো দিয়েই। মাথা রেখে মনে হলো গ্রানাইট পাথরের সঙ্গে বাড়ি খেয়েছি, পিঠের নীচে বেড শীটটা স্যাঁতস্যাঁতে লাগছিলো। এতো কিছু কে দেখে, চোখ জুড়ে ঘুমের সীমাহীন আক্রমন। কোলবালিশ আর কাঁথা আমার নিত্যসঙ্গী, ভাবার সময় নেই । মশাদের সান্নিধ্যে ভ্যাপসা গরমে ঘুমালাম প্রায় দু’ঘন্টা। আমার রুটিন এখানে চলবে না, তাই ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম ঝটপট, নইলে আবার অভূক্ত থাকতে হবে,তেলাপিয়া মাছের দো পেয়াজা খুব টেষ্টি ছিলো। অমৃতের স্বাদ পেয়েছি, জীবনে এতো ভাল খাইনি। খাওয়া শেষে রুমের প্যাসেজে হাঁটা শুরু, একজন ডাকলেন, ও গায়ক সাব এইহানে একটু বইয়া একটা বিড়ি খান, আমনে তো মেশিনের লাহান খানা আর আডা শুরু করসেন। বরিশালের মূলাদীর মানুষ তিনি । পাশে গিয়ে বসলাম, আস্তে আস্তে সবাই আসা শুরু করলেন, আমিও ফর্মে ফেরার সিগন্যাল পেলাম।’
কারাগারের নিঃসঙ্গতাও অনুভব করেছিলেন আসিফ। সন্তানদের মিস করার কথাও জানিয়েছেন, রাত জাগা আমার অভ্যাস। জেলে বাতি বন্ধ হয় না, একটু কমানো হয়। দুটো শ্যুটিং মিস হল এই কারাবাসে, অনুতপ্ত বোধ করছি। নানান ভাবনা মনে, নানান ফ্ল্যাশ ব্যাক চোখে। একা একা শুয়ে হাসি আর রণ রুদ্র’র কথা ভাবি। ওরা মাত্র ক্লাস সিক্সে হোষ্টেলে ঠিক এমনই পরিস্থিতিতে ছিলো, ওরাও নিশ্চয়ই বাসায় শুয়ে আমার জন্যও ভাবছে, আজ দু’রাত ছেলেদের চুমু দেই না। ওরা জানে ওদের বাবা একা একা ভয় পায়, একা থাকতে পারে না। ফজরের শেষে ঘুম জড়িয়ে এলো চোখে, ঠিক সকাল সাড়ে সাতটায় ডাক, হাজিরায় যেতে হবে স্বাক্ষর করার জন্য। মেজাজ খিচড়ে গেলো, সামলে নিলাম পরক্ষনেই, এখানে আমি আগন্তুক, নিয়ম মেনে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ’
সকালের জেলাখানাকে ‘কনসেন্ট্রেশন’ ক্যাম্পের সাথে তুলনা করেছেন আসিফ। লিখেছেন, আমদানীতে নতুন কয়েদীরা বসে আছে, মনে হলো কোন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছি। রাত জাগা সাধারন কয়েদীরা সিরিয়াল মেনে বসে আছে। একটু শঙ্কা জাগলো, আমাকেও কি এভাবে হাঁটু ভেঙ্গে বসতে হবে? নাহ … বেঁচে গেলাম, যথাবিহিত সম্মান জানিয়ে শাওন আমাকে নিয়ে গেলো রেজিস্ট্রি বইটার কাছে। শুধু সাইন করেই মুক্তি পেলাম।
রাইটার ছেলেটা শুধু বললো- কষ্ট করে কেনো এসেছেন !! বেশী কথা না বলার সিদ্ধান্ত যেহেতু নিয়েছি তাই বললাম- নিয়ম ঠিক রাখতে এসেছি, ছবি কখন তুলবেন ? বললো- ভাই সাড়ে দশটায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম- তাহলে কি অপেক্ষা করবো ? আশ্বস্ত হলাম, ওরা বললো আপনি বিশ্রাম করুন, আমরা সাড়ে দশটায় ক্যামেরা নিয়ে আসবো। চান্স পেয়েই বলে ফেললাম- ভাই সাড়ে এগারোটায় আসেন, একটু ঘুমাবো। প্রত্যুত্তর –সমস্যা নাই, কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।’
জনপ্রিয়তার কারণে সুবিধার পাশাপাশি কিছু অসুবিধার কথাও উঠে এসে তার লেখায়, ‘বিভিন্ন সেল এর কয়েদীরা আমার রুমে ঢুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করা শুরু করলো- কেমন আছি !! এমনিতেই প্যাঁচে আছি, শুস্ক হাসি দিয়ে বলেছি, ভালো আছি, একটু ঘুমাতে চাই ভাই। লাভ হলো না … এর মধ্যে আমার কেবিন মেটরা কড়াকড়ি স্থাপন করলেন, আর কেউ ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি অন্ততঃ একঘণ্টার জন্য। যারা আমাকে চেনেন না, এই মানুষগুলো আমার ঘুমের সুযোগ করে দিলেন কোন সম্পর্কের অধিকারে !! আসলেই উনারা কি ভয়ঙ্কর আসামী!! ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা আসলে কি ? আমি অবুঝ হিসেবেই নিজেকে বোঝাতে পেরেছি- ওরাই আমার বন্ধু, কারাবন্ধু। কোনো লেনদেন ছাড়াই ভালবেসে ঋণী করে রেখেছেন …’
যমুনা অনলাইন: এটি
Leave a reply