কৈশোর পেরোতেই বিয়ে হয় অনিমা রাণী সরকারের। সাতক্ষীরার লবণ পানির জনপদে শুরু হয় তার সংগ্রামের জীবন। সংসারটা একটু গুছিয়ে আনতেই ঘূর্ণিঝড় আইলায় তছনছ হয়ে যায় সব। ভেঙে না পড়ে অনিমা আবারও শুরু করেন নতুন করে। বিশুদ্ধ পানির প্লান্ট বসিয়ে হয়ে যান উদ্যোক্তা। আশাশুনির প্রত্যন্ত গ্রামের এ নারী ঘুরে দাঁড়িয়েছেন জীবন যুদ্ধে, জয় করেছেন সব প্রতিবন্ধকতা।
সাতক্ষীরার আশাশুনি গ্রামের নাম যদুয়ার ডাঙ্গা। সুন্দরবন উপকূলের জনপদের জন্য আশীর্বাদ আর অভিশাপ দুটোই নদী। সারা বছর পানির মধ্যেই বসবাস এ জনপদের বাসিন্দাদের।
লবণ পানির সঙ্গে বসবাসে অভ্যস্ত এখানকার স্থানীয়রা। অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমার জোয়ারে তলিয়ে যায় সবকিছু। মাঝে মাঝেই আঘাত করে সিডর-আইলার মতো ঝড়-জলোচ্ছ্বাস। জীবন হয় বিপন্ন, হারিয়ে যায়, তলিয়ে যায় সারা জীবনের জমানো সব সম্পদ।
অনিমা রাণী সরকার বললেন, এসএসসি পরীক্ষা দেবো এ রকম সময়ে বিয়ে হয়ে গেলো, পরীক্ষা দিতে পারিনি আর।
অনিমা রাণী সরকার। বন উপকূলের এই নারীর জীবন যুদ্ধ শুরু তখন থেকেই। সংসার গুছিয়ে এগিয়ে চলার চেষ্টা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারটির। এর মধ্যেই আঘাত হানে জলোচ্ছ্বাস আইলা।
সিডরের দুঃসহ স্মৃতিচারণ করে অনিমা বললেন, বারোটা বাজে এ সময় শুরু হলো ঝড়। মাঝে ঘের বলতে আর কিছু ছিল না, সব সমান হয়ে গিয়েছিল। আমার গরু ছিল ১৬-১৭টা, সব মারা যায় ঝড়ে। এছাড়া ছাগল যে কটা ছিল একটাও বাঁচেনি।
স্বামী-সন্তান নিয়ে কঠিন যুদ্ধের মুখোমুখি তখন অনিমা। আবারও গড়তে হবে সবকিছু। মানুষ করতে হবে মেয়েকে। এমন হাজারও দুশ্চিন্তা মাথায়।
অনিমা বললেন, কিছুই না থাকলে যেমন চলে ওভাবেই চলছিল। তখন তো খেতেই পাই না। এক সাঁঝ খেতাম আরেক সাঁঝ হয়তো খেতাম না।
কিন্তু লবণ পানির এই জনপদে অন্য কী করা যায়? সমাধান মিলে লবণ পানিতেই। বিশুদ্ধ পানির অভাব সেখানে। তাই পরিশোধন প্ল্যান্ট বসানোর পরিকল্পনা করেন অনিমা। একটু চেষ্টা করতেই ঋণও মিলে যায়।
অনিমা বললেন, একজন এসে বললো যে বউদি দুঃসময় তো যাচ্ছে। একটা প্ল্যান্ট বসাও, ভালো বেচাকেনা হবে।
অনিমার স্বামী বললেন, একজন লোকের কাছে সাজেশন নিলাম কীভাবে প্ল্যান্ট বসাবো এ ব্যাপারে। তো কোথায় যেতে হবে? বললো ব্র্যাক অফিসে যেতে হবে। কীভাবে কী করতে হবে ওনারা বলে দেবেন।
আশাশুনির যদুয়ারডাঙ্গায় বসলো অনিমা রানি সরকারের পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট। তারপর শুধু এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
অনিমা রাণী সরকার বলেন, আমাদের তো প্ল্যান্ট আছে। যদি কারো কম পড়ে তাহলে আমাদের প্ল্যান্টের পানিই খায় সবাই। যখন সংকট হয় সবাই এই পানি খায়। তিন-চার হাজার পরিবার পানি নেয় এখান থেকে বলে জানালেন তিনি।
নোনা পানির দেশে মিঠা পানি বিক্রি করে উদ্যোক্তা হয়েছেন উপকূলের এ অদম্য নারী। মেয়েকে পড়াবেন শেষ পর্যন্ত। ঘর আলো করে এসেছে আরেক সন্তান। অনিমার স্বপ্ন আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবেন।
হাস্যোজ্জ্বল মুখে অনিমার স্বামী বললেন, স্বপ্ন তো অনেকদূর যাওয়ার। একটা বোতলজাত পানির কারখানা করার ইচ্ছা। কিন্তু টাকার কারণে পারছি না।
অনিমা বললেন, করতে গিয়ে তো পেরে ওঠা যাচ্ছে না। আমার পরিকল্পনা বড় কিছু করার। কিন্তু যা দরকার তা তো আমার নেই।
প্রকৃতির বৈরীতা সেখানে বড় প্রতিবন্ধকতা। বিশেষ করে নারীদের সেই বৈরী পথ পাড়ি দিতে হয় জীবনভর। অনিমা রাণীদের গল্প একই রকম। এ অঞ্চলে অনিমারা যুদ্ধ করেন প্রকৃতির বৈরীতার বিরুদ্ধে। তবুও তারা থেমে থাকেন না। বিজয় ছিনিয়ে আনেনই শেষ পর্যন্ত। তারাই আমাদের সম্মুখ সারির যোদ্ধা।
/এসএইচ
Leave a reply