‘এই দাবি ভাত-কাপড়ের, এই দাবি জীবন বাঁচানোর’

|

স্টাফ করেসপনডেন্ট, রংপুর:

গ্রাচুইটি এবং পিএফ ফান্ডের টাকার দাবিতে রংপুরের শ্যামপুর চিনিকলের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কর্মচারী কর্মকর্তারা। সমাবেশে বক্তারা বলেছেন, টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছি, অনাহারে থাকছি, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যন্ত পাঠাতে পারছি না। শ্রমিকদের ‘হকের টাকা’ দেয়া না হলে চালু থাকা চিনিকলগুলোতে অবস্থান ধর্মঘটের ঘোষণাও দিয়েছেন তারা। একই দাবিতে চিনিকলের এমডির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন শ্রমিকরা।

শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চিনিকলটির সামনে অবস্থান নেন প্রায় আড়াই শতাধিক শ্রমিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এসময় তারা সেখানে সমাবেশ এবং দফায় দফায় বিক্ষোভ করেন। সমাবেশ ও বিক্ষোভে ‘এই মুহূর্তে গ্র্যাচুইটির টাকা দে, নইলে গদি ছেড়ে দে’, ‘অবসরভাতা বকেয়া কেন, প্রশাসন জবাব দে’, ‘এই দাবি ভাত-কাপড়ের, এই দাবি জীবন বাঁচানোর’ ইত্যাদি নানান শ্লোগান দেন আন্দোলনকারীরা। অনেক অসুস্থ, ক্ষীণ হয়ে যাওয়া শরীর নিয়েও কর্মসূচিতে অংশ নেন। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন শ্যামপুর চিনিকল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সরকার ডাবলু, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মহিউদ্দিন, সাবেক উপ-সহকারী আখ উন্নয়ন কর্মকর্তা সেকেন্দার আলী, উপ-আখ ব্যবস্থাপক নুরুল ইসলাম, আখ সেন্টার ইনচার্জ মাহমুদুল হাকিম ও আকমল হোসেন প্রমুখ।

আন্দোলনে অংশ নেয়া সাবেক উপ আখ ব্যবস্থাপক মোহা. নুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের পাওনাদি আমরা পাচ্ছি না। টাকা পয়সা না পেয়ে আমরা অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছি। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ দিতে পারছি না। এর মধ্যে আমাদের অনেকেই টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। আমরা একই পথের পথিক হয়েছি। সেজন্য বাধ্য হয়ে আমরা এই আন্দোলনে নেমেছি।

আরেক সাবেক কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান বলেন, আমি ২০১৭ সালে রিটায়ার্ড করেছি। এখন পর্যন্ত গ্যাচুইটির টাকা পাইনি। খুব অভাব-অনটনে দিন যাপন করছি, পরিবার-পরিজন খুব কষ্টের মধ্যে আছি, অচিরেই আমাদের পাওনা আমাদের দিতে হবে। তা না হলে আমাদের পথে পথে ভিক্ষা করে পরিবার চালাতে হবে।

অসুস্থ অবস্থায় হাজির হওয়া শ্রমিক হাফিজুর রহমান বললেন, ২০১৬ সালে আমার চাকরি গেছে। আমি কোনো টাকা পাচ্ছি না। আমার বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। ছেলেপেলে লেখাপড়া করতে পারছে না টাকার অভাবে। আমার স্ত্রীর অসুখ। এখন আমি কীভাবে চলবো? কোনদিন আমি টাকা পাবো?

খালেদা নামের এক শ্রমিক জানান, আমার চাকরি গিয়েছে ২০১৮ সালে। আমি অসহায়। আমি টাকা পয়সাও পেলাম না, বাসায়ও থাকতে দিচ্ছে না। কী খেয়ে থাকি, বাসাভাড়া আর বিদ্যুৎ বিলই বা কীভাবে দেই!

সেন্টার ইনচার্জ মাহমুদুল হাকিম জানালেন, ২০১৭ সালে রিটায়ার করেছি। আমি গ্যাচুইটির টাকা পাইনি এখনও। ছেলেমেয়েসহ খুব দুর্বিষহ জীবন যাপন করছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে করজোরে মিনতি, আমাদের গ্রাচুইটির টাকাটা দিয়ে দেবেন। খুবই সামান্য টাকা এটা।

অসুস্থ শ্রমিক কাদের মিয়া জানালেন, ২০১৫ সালে রিটায়ার্ড করেছেন তিনি, কিন্তু পাওনা টাকা পাননি এখনও। বললেন, আমি খুব অসুস্থ, টাকাটা না দিলে আমাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে।

সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মহি উদ্দিন জানান, আমি চল্লিশ বছর চাকরি করার পর রিটায়ার্ড করেছি। তখন থেকে শুনছি দুইশো কোটি, আড়াইশ কোটি টাকা, এই আসছে, এই আসছে। কিন্তু আমরা টাকা পাচ্ছি না। এটা কোন ধরনের কথা? তিনি বলেন, সরকার কি জানে না, ৬টা মিল বন্ধ হয়েছে, তাদের টাকা দিতে হবে?

শ্যামপুর চিনিকিল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সরকার ডাবলু বলেন, আমরা প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারি অবসরে গেছি। আমাদের সাথে জড়িত প্রায় ১২/১৩ হাজার মানুষ নিয়ে যে আমাদের পরিবার। আমরা সবাই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছি। এদেশে এখন অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু চিনি শিল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারী শ্রমিকরা আমরা না খেয়ে আছি। আমাদের অনেকেই দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত। তারা চিকিৎসা করতে পারছেন না। অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজ যেতে পারছে না। আমাদের জীবন চলছে না।

ডাবলু সরকার আরও বলেন, আমরা সারাজীবন চাকরি করে এই শিল্পকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছি। সেই শিল্পে চাকরি করে আমরা অবসরকালীন ভাতা আমরা পাচ্ছি না। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সমাবেশ দিয়েছি। আমাদের দাবি অক্টোবরের মধ্যে পাওনা সরকার আমাদের দিয়ে দেবে। যদি না দেয়া হয় তাহলে আগামী ২৩-২৪ সেশনে যে মাড়াই কার্যক্রম আসবে সেখানে আমরা মাড়াই করতে দেবো না। আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে মিলগেটে অবস্থান ধর্মঘট করবো। একই সাথে তিনি শ্যামপুর চিনিকলসহ বন্ধ সব চিনিকল চালুর দাবি জানান।

পরে দাবি আদায়ে শ্যামপুর চিনিকলের এমডির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেন তারা। স্মারকলিপি গ্রহণ করে এমডি আহসান হাবিব জানান, আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আমিও চাই দ্রুত তাদের পাওনা দেয়া হোক। শ্যামপুর চিনিকলের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্র্যাচুইট, ছুটি ও অন্যান্য বাবদ ১৪ কোটি এবং ভবিষ্যত তহবিলের ৭ কোটি ৬১ লাখ মোট ১৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা দীর্ঘদিন থেকে বকেয়া আছে।

/এডব্লিউ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply