রানি এলিজাবেথের সঙ্গে প্রিন্সেস ডায়ানার সম্পর্ক কেমন ছিল?

|

ছবি: সংগৃহীত

রানি এলিজাবেথের কাছে শেষ পর্যন্ত ডায়ানা ছিলেন ‘সেই ত্যাড়া মেয়ে’। ডায়ানা অবশ্য বলতেন তার শাশুড়িকে তিনি ‘দারুণ শ্রদ্ধা’ করেন এবং তার জন্য সব কিছু করতে রাজি আছেন। কিন্তু মনে হয় না রানি তেমনটা অনুভব করতেন, কারণ রানি দেখেছিলেন ডায়ানা তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পর রাজতন্ত্রের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছিলেন।

বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাইরে থেকে এসে রাজ পরিবারের কাউকে বিয়ে করা একটা সাহসী পদক্ষেপ ছিল ডায়ানার। তার জন্ম হয়েছিল এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। শৈশবের বেশ কয়েক বছর পার্ক হাউস নামের একটি বাড়িতে কাটিয়েছিলেন ডায়ানা। বাড়িটি রানির অন্যতম আবাস স্যান্ড্রিংহামের খুবই কাছে ছিল।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, রাজ পরিবারে প্রিন্সেস হওয়ার সব ধরনের যোগ্যতা আছে এই মেয়েটির। তবে দ্রুতই একটা বিষয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, উঠতি বয়সের আবেগপ্রবণ তরুণী ডায়ানা রাজপ্রাসাদের কঠোর নিয়মনীতি নির্ভর জীবনের জন্য তখনো তৈরি ছিলেন না। এছাড়া রাজপ্রাসাদের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার বিষয়ে হবু স্বামীর সাহায্যও পাননি ডায়ানা। এর পেছনে অবশ্য কারণও ছিল। চার্লস ছিলেন রাশভারী গোছের মানুষ, অপরদিকে ডায়ানা ছিলেন উচ্ছল ও বহির্মুখী চরিত্রের।

তবে ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে নাক গলানোর নীতিতে রানি খুব কমই বিশ্বাসী ছিলেন। অনেক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজ পরিবারে নতুন সদস্য আসলে পরিবারের রীতিনীতি সম্পর্কে পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয়া উচিত ছিল রানির।

ডায়ানা রাজ পরিবারে এসে অসহায় ও বিচ্ছিন্ন বোধ করতেন। তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারতেন না তার কাছে রাজ পরিবারের প্রত্যাশাটা আসলে কী। শুধু তাই নয় ভালো কিছু করলে কখনো প্রশংসা না পেয়ে হতাশ বোধ করতেন। এসব কারণে ডায়ানার ক্ষোভের বহি:প্রকাশে অস্বস্তি বোধ করতেন প্রিন্স চার্লস। ছেলের মতো রানি এলিজাবেথও বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তি বোধ করতেন। মা-ছেলে বুঝতে পারতেন না কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে।

ডায়ানার বড় হয়ে ওঠা আর রানির বড় হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। রানির সময়ে মনের ভাব বা অনুভূতি প্রকাশ করার রীতি ছিল না। অনেকেই মনে করেন, জনমতকে কীভাবে নিজের দিকে টানতে হয় ডায়ানা সে বিষয়টা খুব ভালোভাবে বুঝতেন ও এই দক্ষতা ব্যবহার করতেন। কিন্তু রাজ পরিবার এ বিষয়ে ততটা দক্ষ ছিল না।

এমন অবস্থায় রানি দেখলেন ডায়ানা ও চার্লসের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। অথচ এই বিয়ে থেকে অনেক কিছু আশা করেছিলেন তিনি। পরিস্থিতির উন্নয়নে পাশ থেকে শুধু শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কারণ তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন এক্ষেত্রে তার ছেলের ব্যর্থতা ও পরিণামে এই বিয়ের ব্যর্থতা রাজতন্ত্রের ভবিষ্যতের ওপর বড় ধরনের আঘাত হয়ে আসবে।

চার্লস ও ডায়ানার মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটার পর ছেলের দাম্পত্য জীবন নিয়ে নিজের অবস্থান থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন রানি এলিজাবেথ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তিনি দু’জনকে কথা বলতে ডেকে পাঠান। দু’জনকে অনুরোধ করেন এই বিয়ে টিকিয়ে রাখতে তারা যেন শেষবারের মতো চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। ডায়ানা বিবিসির প্যানোরামার অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকারে নিজের কাহিনি বিশ্বের সামনে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর রানি এ বিষয়ে আবারও হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন।

রানি দু’জনকেই আলাদা করে চিঠি লেখেন। বলেন তাদের সামনে এখন একটাই পথ খোলা আছে, সেটি হলো বিবাহবিচ্ছেদ। তবে নাতিদের কথা মাথায় রেখে ডায়ানার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন রানি। কিন্তু চার্লসের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর রানি ও ডায়ানার মধ্যে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়।

ডায়ানার মৃত্যুর পর রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি জনগণের মনমানসিকতা বুঝতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। রানি তখন তার শোকাহত দুই নাতিকে সান্ত্বনা দিতে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে অবস্থান করেন। কিন্তু সংবাদপত্রগুলোতে ডায়ানার মৃত্যু নিয়ে রানির প্রতিক্রিয়া নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ নাটকীয় নানা শিরোনাম আসতে থাকতে। জনমতেও এর প্রতিফলন ক্রমশ বাড়তে থাকায় তিনি লন্ডনে ফিরে আসতে বাধ্য হন।

ডায়ানার শেষকৃত্যের আগের দিন রানি নজিরবিহীন এক টেলিভিশনে ভাষণ দেন, যাতে তিনি তার পুত্রবধূ সম্পর্ক খোলামেলা কথা বলেন। তার সেই সম্প্রচার ছিল যুগান্তকারী। এতে রানি, রাজকুমারী ডায়ানার আবেগ এবং সমাজে তার অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বলা হয়, রানি তার এই ভাষণের মধ্যে দিয়ে রাজতন্ত্রকে একটা বিপর্যয়ের দোরগোড়া থেকে উদ্ধার করেছিলেন।রাজকুমারী ডায়ানার মরদেহ নিয়ে কফিন বাকিংহাম প্রাসাদের ফটক অতিক্রম করার সময় রানি তার পুত্রবধূকে শেষ বিদায় জানিয়েছিলেন।

যে তরুণ রাজকুমারী এত লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালোবাসা আর সম্মানে সিক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু শাশুড়ির কাছে থেকে গিয়েছিলেন একটা হেঁয়ালি হয়ে, সেই নারীর শেষ বিদায়ে মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন রানি এলিজাবেথ।

ইউএইচ/


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply