রিমন রহমান:
আর কয়েকদিন পরই বাজেট ঘোষণা। সাক্ষাৎকারের জন্য সময় চাইলাম, ফোন ধরে সময় দিলেন একদিন পর। গুলশানের বাসায় নিচে গেলে ব্যক্তিগত ড্রাইভার সৌরভদা সঙ্গী হলেন। নিয়ে গেলেন যে রুমে, সেটি আমার পূর্ব পরিচিত। কারণ এর আগে অনেকবার এখানেই সাক্ষাৎকার নিয়েছি। ছোট্ট রুম। কতো হবে! ৮ হাত বাই ৮ হাত। কাঠের র্যাকে থরে থরে দেশি-বিদেশি বই। একটি টেবিল, সেখানে একটি কম্পিউটার রাখা। হাসপাতালের রোগীর থাকার মতো একটা সরু বেড এবং দুটি চেয়ার। কিছুক্ষণের মধ্যে এলেন। তবে, তাকে ধরে নিয়ে এলেন একজন। ক্রাচে ভর দিয়েই তিনি হাঁটাচলা করেন। অনেকদিন ধরেই হাঁটার ক্ষেত্রে লাঠিতে নির্ভরশীল।
সাক্ষাৎকার দেবার জন্য প্রায় অর্ধভাঙ্গা একটি চেয়ারে বসলেন যিনি তার নাম ড. আকবর আলি খান। এর আগে যতোবার সাক্ষাৎকারের জন্য ফোন দিয়েছি, ততোবারই বলতেন, প্রশ্ন কী? শুনে তিনিই বলতেন, ‘ও তাহলে ১০ মিনিট। অথবা ১৫ মিনিট লাগবে। কেন যেন এবার তিনি প্রশ্ন এবং সাক্ষাৎকারের সময় বললেন না।
৩ জুন, ২০২২, শুক্রবার। শুরু হলো সাক্ষাৎকার। যেহেতু বাজেট নিয়ে প্রশ্ন, তাই শুরু করলাম। প্রশ্ন শুনে উত্তর দিতে শুরু করলেন। রাজস্ব আয়ে সীমাবদ্ধতা, ডলার বাজারে বিশৃঙ্খলা, মূল্যস্ফীতি এবং দরিদ্র মানুষ নিয়েই বেশি গুরুত্ব দিলেন। বললেন, এবারের পরিস্থিতি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন।
এবার যখন তার সাক্ষাৎকার নিতে বসি, তখন কেন জানি মনে হচ্ছিল, তিনি শারীরিকভাবে আগের চেয়ে বেশি দুর্বল। হয়তো দিন দুনিয়ার খবর রাখেন না। অসুস্থতা, ক্লান্তি, অবসাদ তাকে ঘিরে ধরেছে। স্ত্রী, একমাত্র সন্তান হারিয়ে তিনি বিমর্ষ। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর যখন তিনি দেয়া শুরু করলেন তখন ঠিকই বিশ্ব অর্থনীতি, তার সঙ্গে দেশীয় অর্থনীতির সংশ্লিষ্টতা, বাজেট বাস্তবায়নে চাপ, দরিদ্র মানুষের কষ্ট আগের তুলনায় আরও বেড়েছে; এমন নানান প্রাসঙ্গিক কথা বলে গেলেন।
মনে মনে পুলকিত হলাম। কারণ যদি তিনি সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ অথবা সংকট উত্তরণ প্রসঙ্গে না বলেন, তাহলে প্রতিবেদনটি জুতসই হবে না। যেহেতু তিনি সব জেনে বুঝে বলে যাচ্ছেন, এতে আমি অবাকই হলাম। মনে হলো, মানুষ সম্পর্কে আমার ধারণার ঘাটতি আছে। তিনি সংবাদের সঙ্গেই থাকেন। অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি এই বয়সেও তার নখদর্পণে।
শুরুতেই বললেন, সংসদে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করবেন, সেই বাজেট আগের ধারাতেই রয়েছে। অর্থাৎ এই বাজেটে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হবে। এবং সরকার যে পরিমাণ আয় হবে বলে হিসাব করবে, তার সংস্থান করা যাবে না। হাজার হাজার কোটি টাকা কমাতে হবে। তার ধারণাই ঠিক। বাজেটের আকার বড় হয়েছে, ঘাটতি অনেক। সরকারের অভ্যন্তরীণ আয়ের সুনিদিষ্ট পরিকল্পনা নেই। বরাবরের মতোই বছর শেষে কাঁটছাট করতে হবে।
এরপরই তিনি এলেন সমসাময়িক বিষয়ে। বললেন, এবারের বাজেট নতুন সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। যথার্থই বললেন, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এবং তিনি এও বললেন, সামনে আরও বাড়বে। তার কথাই সত্যি হলো। এখন মূল্যস্ফীতি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে।
এরপর তিনি যে প্রসঙ্গটি জানালেন, তা খুবই সত্য কথা। বললেন, মূল্যস্ফীতির হার যতো বেড়ে যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি গতিতে বেড়ে যাচ্ছে গরিব মানুষের মূল্যস্ফীতির হার। তিনি বললেন, সরকারি হিসেবে জাতীয়ভাবে মূল্যস্ফীতির হার ৭-৮ ভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে, দরিদ্র মানুষের মূল্যস্ফীতির হার আলাদাভাবে যদি হিসাব করা হয়, তাহলে দেখা যাবে ৩০-৪০ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গেছে। এতো বড় মূল্যস্ফীতির হার সামাল দেবার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষদের নেই। এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে তিনি পরামর্শ দেন।
মূল্যস্ফীতি এবং দরিদ্র মানুষ- দুটি বিষয় নিয়ে তার যে শঙ্কা তা যেন বর্তমান প্রেক্ষাপটের প্রতিচ্ছবি। তিনি ঘরের কোণায় বসে অর্থনীতির এই অভিঘাতের পূর্বাভাস ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। যতোই দিন যাচ্ছে ততোই মনে হচ্ছে এই দুই দিক সামাল না দেয়া গেলে অবস্থা কঠিন হবে।
আরও একটি কঠিন সত্য তিনি বললেন। যে বিষয়টি আমার মনের মধ্যেও প্রশ্ন জাগায়। জানালেন, বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা হয়। তবু এখনও চাল আমদানি করতে হয়। গম তো ৭০ ভাগ আমরা বিদেশ থেকে আনি। এর যে মূল্য তা নির্ভর করবে ডলারের বিনিময় হারের ওপর। তিনি বললেন, ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের মুদ্রার মান ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এবং এটা রোধ করা একা সরকারের পক্ষে সম্ভব না। এটা আন্তর্জাতিক একটি প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ায় যদি আমরা টাকার মানকে পুনরুদ্ধার না করতে পারি, তাহলে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে যাবে।
তিন মাস আগে যখন তিনি এই শঙ্কার কথা বললেন, তখন আমি অন্তত ডলার নিয়ে এমন সংকট তৈরি হবে বুঝতে পারিনি। ডলার ব্যবস্থাপনা যে শুধু সরকারের একার নিয়ন্ত্রণে না, তাও এখন স্পষ্ট। বিদেশি এই মুদ্রার লেনদেন বিশৃঙ্খলার কারণে যে কতো ধরনের সংকট হতে পারে তাও এখন স্পষ্ট।
করোনা মহামারির সময় মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দেবার প্রসঙ্গ টেনে এনে তিনি বললেন, তখন বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি এবং সুদের হার কমিয়ে আনা হয়। এই অবস্থাতে যদি; যে ঋণ দেয়া হয়েছে সেই ঋণ ফেরত না পাওয়া যায়, এবং ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার উন্নতি না হয় তাহলে এখানে মুদ্রাস্ফীতির প্রবাহ আরও বেড়ে যাবে।
সরকারের করণীয়ও তিনি বাতলে দিলেন। বললেন, যেটা করতে হবে সেটা হলো রাজস্ব নীতি কঠোর করতে হবে। সরকারের ব্যয় কমাতে হবে। তবে সরকারের ব্যয় কমানোর তেমন কোনো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না। দেশে অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করতে হবে। এ কথা বলা হলেও তা কেউ শোনে নাই। সরকারের প্রতিটি ব্যয় পুনঃনিরীক্ষা করে কতোটুকু খরচ করা যাবে কতোটুকু খরচ করা যাবে না সেটা নির্ধারণ করতে হবে।
বলেছিলেন, আমি যে পরামর্শগুলো দিয়েছি, তা হয়তো অর্থমন্ত্রী নীতিগতভাবে মানবেন না। তার কথা মিলে গেল। বাজেট ঘোষণার পর সরকার ব্যয় সংকোচনের পথে হেঁটেছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনা এবং প্রকল্প ব্যয়ও কাঁটছাট করেছে সরকার। এখানেও ড. আকবর আলি খান বর্তমান। তিনি যেন দেখছিলেন, কী হবে আগামীতে।
প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রেও জোর দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের সুদৃঢ় প্রশাসন পরিচালনা করতে হবে তা বাংলাদেশে সম্ভব হবে কি না সেটি বড় প্রশ্ন। যদি সেটা না করা যায় তাহলে আমরা সংকটের আবর্তন থেকে মুক্ত হতে পারবো বলে মনে হয় না।
দরিদ্র নিম্নবিত্তদের জন্য নানামুখী নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। তবে, প্রকৃত অর্থে যাদের এই নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির আওয়াত আসা দরকার ছিল, তারাই নানাভাবে এ থেকে বঞ্চিত হয়। এসব বিষয় নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় না। সাক্ষাৎকারে এই বিষয়টিও এড়িয়ে যাননি তিনি। বললেন, নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে দেয়া নানান সুবিধা যাতে গরিবরা পায় সেটা নিশ্চিত করা দরকার। সব ব্যয়ের ব্যাপারে প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে। যদি সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে তাহলে হয়তো আমরা আবর্তের মধ্যে জড়িয়ে পড়বো না।
দীর্ঘদিন ধরে দেখছি, অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে নানামুখী সংকট আছে। করযোগ্য মানুষ থাকলেও তাদের খুঁজে বের করার কার্যকর উদ্যোগ নেই। পাশাপাশি কর ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশন করার উদ্যোগও নানান কারণে থমকে গেছে।
ড. আকবর আলি খান রাজস্ব আদায় নিয়েও পরামর্শ দেন। বলেন, এখনও বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের হার পৃথিবীর নিম্নতম পর্যায়ে রয়েছে। এ অবস্থা থেকে একবারে মুক্তি পাওয়া সম্ভব না। তবে, মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। অধিক মানুষদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতে হবে। কিন্তু এগুলো অপ্রীতিকর কাজ। এগুলো করে জনগণের হাততালি পাওয়া যাবে না।
রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে রাজনীতির সম্পৃক্ততাও তুলে আনলেন তিনি। বললেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে কর ব্যবস্থায় কতোটা কঠিন হওয়া যাবে, সরকার সেই পথে পা দেবে কিনা তা চিন্তার বিষয়। এক্ষেত্রে সন্দেহ আছে।
বাজার ব্যবস্থা নিয়েও পরামর্শ উঠে আসে। বলেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। বিশ্ব বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দরকার। এই খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হলে অন্যত্র ব্যয় কমাতে হবে।
মাত্র ১০ মিনিটের সাক্ষাৎকারের পুরোটাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক। স্বল্প সময়েই তিনি তুলে ধরলেন অর্থনীতির সবদিক।
মৃত্যু অনিবার্য। চীনের বিপ্লবের নায়ক মাও সেতুং বলেছিলেন, কোনো কোনো মৃত্যু আছে ফিনিক্স পাখির পালকের মতো হালকা, আবার কোনো কোনো মৃত্যু আছে থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী। ড. আকবর আলি খানের চলে যাওয়া সেরকমই এক অপূরণীয় ক্ষতি।
লেখক: অর্থনীতি বিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, যমুনা টেলিভিশন।
Leave a reply