চলে গেলেন কিংবদন্তি ফরাসি পরিচালক জঁ লুক গদার। মঙ্গলবার ((১৩ সেপ্টেম্বর)) না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী এই নির্মাতা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ঘনিষ্ঠজনেরা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
ফরাসি চলচ্চিত্রে প্রচলিত ধারার বিপরীতে ত্রুফো, শ্যাবরলদের নিয়ে ফ্রান্সে ‘নিউ ওয়েভ’ বা নব্য ধারার চলচ্চিত্রের জন্ম দিয়েছিলেন গদার ‘ন্যুভেল ভগ’, যাকে ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ বা নবতরঙ্গ বলা হয়। আর এই নিরীক্ষামূলক আন্দোলন মূলত শুরু হয় গদারের পরিচালনায় প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ব্রেথলেস’র (১৯৬০) মাধ্যমে।
ফরাসি চলচ্চিত্রে তখনকার বিদ্যমান সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়ান গদার। আপাতদৃষ্টিতে অপরিচিত শৈলীতে গদারের হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার কাজে ধাক্কা খায় চিরাচরিত পারিপাট্য ও চিত্রায়নের ব্যাকরণ। সেই সাথে, ষাটের দশক থেকে একের পর এক রাজনৈতিক বার্তাসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে নিজের কাজের ছাপ কেবল ফরাসি অঙ্গনেই রাখেননি গদার; অনুপ্রাণিত করেছেন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার মার্টিন স্করসিস, কোয়েন্টিন ট্যারেন্টিনো, স্টিভেন সোডারবার্গ, ভিম ভেন্ডার্স, বেরনার্দো বেরতোলুচ্চি, রবার্ট অল্টম্যান, জিম জারমুশদেরও।
১৯৩০ সালে প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন জঁ লুক গদার। সুইজারল্যান্ডের লেক জেনেভার পাড়ে বেড়ে ওঠা গদার ১৯৪৯ সালে ফিরে আসেন প্যারিসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্যারিসে বুদ্ধিবৃত্তিক চলচ্চিত্রপ্রেমীদের সাথে মেলামেশা শুরু হয় তার। গড়ে তোলেন সিনে ক্লাব। সমালোচক আদ্রে বাজিন, সে সময়কার চলচ্চিত্রের আগ্রহী ছাত্র ফাঁফ ত্রুফো, ক্লদ শ্যাবরল, জাঁক রিভেটদের সাথে চলচ্চিত্র সাময়িকীর কাজে হাত দেন গদার। হলিউডে প্রচলিত ধারার বাইরের ভাবনাতেই আগ্রহী ছিলেন গদার। ১৯৫৭ সালে গদারের নির্মিত শার্লোট অ্যান্ড ভেরোনিকা, অল দ্য বয়েস আর নেমড প্যাট্রিক শর্টফিল্ম জানান দিতে থাকে তার উপস্থিতি।
এরপর ১৯৬০ সালে নির্মিত গদারের প্রথম চলচ্চিত্র ব্রেথলেস‘ র সাফল্য ও আঙ্গিক তাকে এনে দেয় সেলুলয়েডের জগতে তার স্থায়ী আসন। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পান গদার। কৃত্রিম আলোর ব্যবহার প্রায় শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা, প্রতিদিন শ্যুটিংয়ের আগে সেদিনের সংলাপ লিখে ফেলা, প্যারিসের পথে পথে দৃশ্যায়ন-এমন নতুন সব ফর্মুলায় ব্রেথলেস হয়ে যায় ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের এক মাস্টারপিস। আর এই চলচ্চিত্রের নির্মাণপর্বেই গদার লেখেন তার অমর বাণী, চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রয়োজন কেবল একটি বন্দুক ও একজন নারী। আর এই চলচ্চিত্রেই তিনি প্রথমবারের মতো নিয়ে আসেন সম্পাদনের সম্পূর্ণ নতুন এক কৌশল, জাম্প কাট।
ফরাসি সরকারের অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরে গদারের পরের চলচ্চিত্র লা পেতি সোলদাত। ফরাসি সরকার এই চলচ্চিত্রটি ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত সে দেশে নিষিদ্ধ রাখে। গদারের পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলো যেমন কনটেম্পট , আ ম্যারিড উইম্যান ‘এ প্রবেশ করে নৈরাশ্য, অস্তিত্বের সংকট। তারপর সোশ্যালিজম কিংবা গুডবাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ‘র মতো কাজে সময়টাকে ধরতে ও বুঝতে চাইলেন গদার।
২০১০ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি চলচ্চিত্রে অবদান রাখার জন্য বিশেষ অস্কার পান এই মহান চলচ্চিত্রকার। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। গেল বছরের শুরুতে গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, চলচ্চিত্র জগত থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছেন তিনি। ২০০২ সালে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র সাময়িকী ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এর জরিপে সর্বকালের সেরা ১০ নির্মাতার মধ্যে জায়গা করে নেন জঁ লুক গদার। এছাড়া ২০১৮ সালে ৭১তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে গদারকে দেয়া হয় বিশেষ পাম দ’র পুরস্কার। ‘দ্য ইমেজ বুক’ সিনেমার জন্য তাকে সম্মানিত করেছিল উৎসব কর্তৃপক্ষ।
গদারের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- দ্য লিটল সোলজার (১৯৬০), আ উইম্যান ইজ আ উইম্যান (১৯৬১), মাই লাইফ টু লিভ (১৯৬৩), কনটেম্পট (১৯৬৩), পিয়েরে ল্য ফু (১৯৬৫), মেইড ইন ইউএসএ (১৯৬৬), উইক অ্যান্ড (১৯৬৭), নিউ ওয়েভ (১৯৯০), জেএলজি/জেএলজি (১৯৯৪), গুডবাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ (২০১৪) প্রভৃতি। এসব রুদ্ধশ্বাস চলচ্চিত্রের জন্যই কাঁচাপাকা চুল আর মোটা ফ্রেমের চশমাতেই অমর হয়ে থাকবেন জাম্প কাট’র স্রষ্টা জঁ লুক গদার।
/এম ই
Leave a reply