মেয়েদের হাত ধরে বাংলাদেশের ফুটবল প্রবেশ করলো এক নতুন দিগন্তে। ২০০৩ সালে পুরুষ দলের পর এই প্রথম নারী সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেছে সাবিনা-কৃষ্ণারা। এরপর থেকেই সারাদেশের মানুষ ফেটে পড়ছে উচ্ছ্বাসে। প্রকাশ করছে তাদের আনন্দ। শুভেচ্ছা বার্তায় সয়লাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তবে মেয়েদের এমন সাফল্যের মাঝেও এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা দেখা গেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ফেসবুক পেজে। খেলা শেষ হওয়ার প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর যেন ঘুম ভেঙেছে তাদের! আর সেখানে ছিল দায়সারা এক পোস্ট। কেবল ম্যাচের পরিসংখ্যানকে এমনই সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরা হয়েছে যে, বয়সভিত্তিক কোনো আসরের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচেও ঠিক এমনভাবেই জানানো হয় ম্যাচের ফলাফল। সাম্যবাদের এক অদ্ভুতদর্শন পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেই যেন কোনো শুভেচ্ছা বার্তাও জানানো হয়নি বাফুফের পেজে!
চ্যাম্পিয়ন দলের ফুটবলার সানজিদা আখতারের গতকাল দেয়া এক ফেসবুক পোস্ট হয়েছে ভাইরাল। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন, কতটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে তাদের। জানিয়েছেন, ‘দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।’ তবুও সানজিদার লেখায় কোনো অসন্তোষ ছিল না। ছিল ‘নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই’ এর মতো দৃঢ়সংকল্প। আর তাতে আবেগে ভেসেও গেছে ফুটবলপাগল এই জাতি।
অবশ্য ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের উন্মাদনা তো কেবল প্রকাশ পায় চার বছর পরপর। বিশ্বকাপ ফুটবলের তুমুল উন্মাদনার বিপরীতে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলার প্রতি দেশবাসীর আশ্চর্য নিস্পৃহতাকেই যেন প্রশ্ন করে বসে সানজিদার ফেসবুক পোস্ট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের ফুটবলকে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের এই আসর অনেকটাই যেন জাগিয়েছে আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচানোর মতো করে!
তবে এই জনজোয়ারে সামিল হতেও যেন বাফুফের অনিঃশেষ অনীহা! ম্যাচের হালনাগাদ তথ্যই যেখানে ঘুরছে সকলের নিউজফিডে, সেখানে ম্যাচ শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক পরেও অপরিবর্তিত অবস্থা বিরাজ করেছে বাফুফের ফেসবুক পেজে! অবশেষে তাদের পোস্ট আসে; কত মিনিটে কে গোল করেছে- এমন প্রাথমিক পরিসংখ্যান সংবলিত এক পোস্ট। সেই পোস্টের কমেন্ট সেকশনে গেলেই পরিষ্কার হয়, এই সংস্থার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়ে কতটা অনাস্থা ও অসন্তোষ জমা মানুষের মনে! এক ব্যক্তি কমেন্টে লিখেছেন, ‘বড় উপকার করছেন এখন জানায়ে। আরেকটু পরে করলেও পারতেন, এই ধরেন দশ বছর পর।’ কেউ কমেন্ট করেছে, ‘স্যার আপনাদের ঘুম অবশেষে ভাঙলো?’
বাংলাদেশের মানুষের ফুটবলপ্রীতি সর্বজনবিদিত। তবে জাতীয় পুরুষ দলের পারফরমেন্সের নিম্নমুখী যাত্রা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে অনেক বড় এক অংশ, যারা তাদের ফুটবল তৃষ্ণা নিবারণ করে ইউরোপিয়ান ফুটবল দেখে। তবে যখন দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে একের পর এক ক্লিনশিট রেখে প্রতিপক্ষকে গোলের বন্যায় ভাসাচ্ছে নারী ফুটবল দল, পুরো আসরে ১ গোল খাওয়ার বিপরীতে প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠিয়েছে ২৩ বার, আগের পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন দলকে হারিয়ে উঠে এসেছিল সেমিফাইনালে- তখন বাফুফের ফেসবুক পেজের আশ্চর্য নীরবতা যেন তাদের আন্তরিকতার স্বল্পতা ও পেশাদারিত্বের ঘাটতিকেই জানান দেয়। এক নেটিজেনের কমেন্টে তো এসেছেই, ‘যাক, পি আর টিম তাদের চাকরী বাচাইলো!’
সানজিদা তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, “…যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই।… ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়বো এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে…।”- দেশবাসীর ভাগ্য ভালো। সাবিনা-সানজিদাদের নিয়ে চাকরি বাঁচানোকেন্দ্রীক কোনো মনোভাব পোষণের কোনো অবকাশই রাখেননি কৃষ্ণা রানি-মারিয়া মান্ডারা। বরং, অপরাজিতভাবে ফাইনালে আসা নেপালকে হারিয়ে শামসুন্নাহার-রুপনা চাকমারা প্রমাণ করেছেন, ফাইনালে সতিকার অর্থেই খেলেছে এগারোজনের এক যোদ্ধাদল।
যমুনা নিউজের পক্ষ থেকে আপনাদের অভিনন্দন, বাঘিনীরা!
/এম ই
Leave a reply