করোনাকালীন সময়ে আবারও আমরা বিশ্ব হার্ট দিবসে পৌঁছেছি। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ২৯ সেপ্টেম্বরে পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। বিশ্বে প্রায় প্রতি বছর ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষ হৃদরোগে মারা যায় এবং বিশ্বজুড়ে ৫২ কোটি হৃদরোগী রয়েছেন; যারা বর্তমানে করোনাকালে আরও বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। জিনেটিক্সের মতো হৃদরোগের জন্য কয়েকটি ঝুঁকি আছে যা পরিবর্তন করা যায় না, তবে জীবনযাত্রার পরিবর্তন দ্বারা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। হৃদরোগের বিকাশের জন্য ধূমপান বা তামাক ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাই ধূমপান ত্যাগ হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ৩০ মিনিটের নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার সাথে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সংমিশ্রণ করা আরও বেশি উপকার যুক্ত করে। কিছু খাবার রয়েছে যা উদ্ভিদের ফলের মতো গোটা দানা জাতীয় খাবার, স্বল্প চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাতীয় খাবার, মাছ, ত্বকবিহীন মুরগী, ডিম, বাদাম, বীজ, লেগুম এবং তেল জাতীয় সয়াবিন তেল এবং সূর্যমুখী তেলের মতো একচেটিয়া এবং বহু সংশ্লেষিত চর্বিযুক্ত হিসাবে বিবেচিত হয় অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট, আচারযুক্ত এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলি এড়ানো উচিত।
হৃদরোগ প্রতিরোধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা । ১৮ বছর বয়সেই নিয়মিত রক্তচাপের স্ক্রিনিং, কোলেস্টেরল স্তর এবং ডায়াবেটিস রোগীদেরও নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা শুরু করা উচিত।
বিশ্ব হার্ট দিবস এবং এবারের প্রতিপাদ্য: হৃদরোগ বিশ্বে মৃত্যুর এক নম্বর কারণ। প্রতি বছর সারাবিশ্বে প্রায় ১৮.৬ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরন করেন হৃদরোগের কারণে। হৃদরোগ হবার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে যেমন-ধূমপান, ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থুলতা, মেটাবলিক সিনড্রোম, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, আধুনিক আরামপ্রিয় অলস জীবনযাপন, বায়ু দূষণ প্রভৃতি। বিশ্বের প্রায় ৫২০ মিলিয়ন মানুষ যারা হৃদরোগে আক্রান্ত, কোভিড-১৯ তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে নিয়ে এসেছে। হৃদরোগীদের মধ্যে কোভিড হবার প্রবণতা খুব বেশি। অনেকেই এজন্য ভীত হয়ে তাদের নিয়মিত এবং জরুরি মেডিকেল ফলোআপ থেকে বিরত থাকছেন। এবং দিন দিন বন্ধু ও পরিবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
এবছরে বিশ্ব হার্ট দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ হৃদয় দিয়ে হৃদকে ভালোবাসুন প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করুন’
কোভিড প্যানডেমিক আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যসেবার দুর্বল দিক এবং আমাদের হৃদরোগীদের জন্য ভিন্ন এবং অত্যাধুনিক উপায় খুঁজে বের করার তাগিদ অনুভব করতে বাধ্য করেছে। ডিজিটাল স্বাস্থ্য সেবার অধিকতর উন্নয়নের মাধ্যমে হৃদরোগের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে সারাবিশ্বের হৃদরোগের প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করাই বিশ্ব হার্ট দিবস ২০২২ এর প্রধান উদ্দেশ্য।
টেলি-স্বাস্থ্য সেবা, হৃদরোগ ও রক্তনালি জনিত রোগ প্রতিরোধে বিশাল ভূমিকা পালন করতে পারে। এর তিনটি প্রধান হলো-
১. সমতা- বিচ্ছিন্ন হৃদয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি হৃদরোগের ও কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকিতে থাকেন। এর কারণ, প্রতিরোধের সুযোগ না থাকা, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের অভাব। বিশ্বের অর্ধেক মানুষ এখনও ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধার বাইরেই রয়েছেন। আধুনিক প্রযুক্তি ও তথ্য দ্রুততম সময়ে আমাদের এ দুর্বলতা ঢাকতে পারে। নারী-পুরুষ, রোগী, স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী, চিকিৎসক, আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে সকলকে সকলস্থানে ডিজিটাল স্বাস্থ্য সেবার আওতায় আনতে হবে। যা রোগ প্রতিরোধ, নির্ণয় এবং হৃদরোগের সেবায় অধিকতর কার্যকর। সকল হৃদয় সমান নয়। কিন্তু তা হওয়া উচিত। ডিজিটাল স্বাস্থ্য সেবা তা প্রতিকার করতে পারে।
২. প্রতিরোধ- স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাবার, ধূমপান ত্যাগ, ও প্রাত্যহিক শারীরিক ব্যায়াম প্রভৃতি হার্ট ভাল রাখে। ফোন অ্যাপস, পরিধানযোগ্য ডিজিটাল যন্ত্র, আমাদেরকে সঠিক পথে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। আপনার যদি হৃদরোগ, হার্ট ফেইলিয়র, ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা স্থুলতা থাকে, তাহলে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিকে ভয় না করে, আপনার নিয়মতান্ত্রিক ফলোআপ এবং জরুরি পরিসেবা গ্রহণ চালিয়ে যান। কারণ আপনার সেবার জন্য সেখানে দক্ষ স্বাস্থ্য সেবা কর্মী আপনার অপেক্ষায় রয়েছেন।
৩. কমিউনিটি- সারা বিশ্বের ৫২০ মিলিয়ন মানুষের কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ আছে, তারা বিভিন্ন মাত্রায় গত একবছরে কোভিডের ভূক্তভোগী হয়েছেন। যেহেতু তারা কোভিডে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে আছেন, তাই তাদেরকে বাইরে না যেতে বলা হয়েছে। এর কুফল হিসেবে, তারা তাদের নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ করেননি, পরিবার ও বন্ধুবান্ধব থেকে দূরে সরে গেছেন এবং শারীরিক ব্যায়াম করাও কমিয়ে দিয়েছেন। ডিজিটাল নেটওয়ার্কের শক্তি অপরিসীম; যা প্রতিটি হৃদরোগীকে তাদের বন্ধুবান্ধব, পরিবার, অন্য রোগী, চিকিৎসক ও সেবাদানকারীদের সাথে যোগাযোগ করতে সাহায্য করতে পারে। কোনো হৃদরোগী যেনো তাদের নিজেদেরকে একা না ভাবেন, প্যানডেমিক থাকুক বা না থাকুক। সুতরাং, হৃদরোগীদের উচিত প্রযুক্তির মাধ্যমে এই একাকীত্ব ও প্রতিবন্ধকতাকে জয় করা।
এখন মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো হৃদরোগ। প্রতিবছর বিশ্বে যে পরিমাণ লোক মারা যায় তার ৩১ শতাংশই মারা যাচ্ছে হৃদরোগে। এখন যে হারে হৃদরোগ হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০৩০ সালে বিশ্বে ২৩ মিলিয়ন লোক মারা যাবে।
হৃদরোগের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো। ভৌগোলিক কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলদেশ, ভারতসহ ও অঞ্চলে হৃদরোগে ঝুঁকি বেশি। কারণ আমাদের দেশের মানুষ অল্প বয়সে ধূমপান করে, চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খায়। কোন খাবার স্বাস্থ্যকর আর কোনটা অস্বাস্থ্যকর, সে বিষয়ে আমাদের দেশের অনেকেরই ধারণা কম। আবার ভৌগোলিক কারণে এ দেশের মানুষের উচ্চতাও কম এর ফলে তাদের হার্টের করোনারি আর্টারি (ধমনি) সরু থাকে। এজন্য সাধারণত অল্পতেই তা কোলেস্টেরলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয়: কিছু বিষয় আছে যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না তবে হৃদরোগের জন্য বেশ কয়েকটি মূল ঝুঁকির কারণগুলি জীবনযাত্রার পছন্দগুলির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সুসংবাদ হলো, যদিও জেনেটিক্সের মাধ্যমে আপনার পিতামাতার কাছ থেকে কিছু সমস্যা চলে আসতে পারে, তবুও স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন আপনার কিছু রোগ হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করতে পারে।
হৃদরোগ হওয়ার অসুবিধাগুলি কমাতে আপনি যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারেন:
১. ধূমপান ও তামাক ব্যবহার করবেন না। শুধুমাত্র ধূমপান ছেড়ে দিয়েই আপনি আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি পঞ্চাশ শতাংশ হ্রাস করতে পারেন। ২. চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত অ্যান্টিহাইপারটেনশন ওষুধ না খাওয়া। ৩. সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনে প্রায় ৩০ মিনিট হলেও ব্যায়াম করা।
৪. কোলেস্টেরল জাতীয় খাবার না খাওয়া। ৫. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
৬. বেশি করে আঁশযুক্ত খাবার খান।
৭. স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা জমাট-বাঁধা চর্বি জাতীয় খাবার কমিয়ে ফেলুন।
৮. লবণকে বিদায় জানান।
৯.ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।
১০. শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমিয়ে ফেলুন।
১১.পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে এবং মানসিক চাপ মুক্ত থাকতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক এস এম মোস্তফা জামান
কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
সভাপতি, বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশন।
/এসএইচ
Leave a reply