২০০৪ সালের নভেম্বর মাস। ইংলিশ লিগের বাইরের ক্লাব গারফোর্থ টাউনের হয়ে একটি প্রচারণামূলক ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার সক্রেটিস। মেডিকেল ডিগ্রির কারণে ‘দ্য ডক্টর’ খ্যাত সক্রেটিস সাক্ষাৎকার দিতে বসেছিলেন স্থানীয় একটি পানশালায়। সেখানেই কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নিজের পরিচিত পরিবেশের বাইরে বসে দুম করে এক স্বীকারোক্তি দিয়ে বসেন সক্রেটিস। বলেন, ১৯৮২ বিশ্বকাপে ইতালির কাছে ২-৩ গোলে হেরে যাওয়া ম্যাচটির দিকে আর কখনোই ফিরে তাকাইনি। তার ভাষায় ‘অসহ্য’ সেই স্মৃতির দিকে না ফেরার সংকল্পটি টিকে ছিল ২০১১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত; ৫৭ বছর বয়সে সক্রেটিসের মৃত্যুবরণ পর্যন্ত।
আজ থেকে ৪০ বছর আগে বার্সেলোনার এক রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে মাঠে গড়িয়েছিল সেই ম্যাচ। আসরের মাঝেই পুরোপুরি বদলে যাওয়া ইতালির কাছে সেদিন বিশ্বকাপ স্বপ্নকে কাঁচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যেতে দেখেছিল তারকাখচিত ব্রাজিল। সময়ের সাথে অনেকের কাছেই এটি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া আরও এক হাইভোল্টেজ নকআউট। তবে সক্রেটিসের মতো অনেকের কাছেই সেদিন ফুটবলের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল এক ঘৃণ্য অপরাধ; যাতে মৃত্যু হয়েছিল ফুটবলের।
ঘটনার দিকেই মনোযোগ দেয়া যাক। ১৯৮০ সালের শুরুতে ব্রাজিল ফুটবল দলের কোচ হন টেলে সান্তানা। ফুটবল ক্যারিয়ারে ফেয়ার প্লের জন্য সুখ্যাত সান্তানা চেয়েছিলেন, তার দলেও এর ছাপ থাকুক। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ভেনেজুয়েলা ও বলিভিয়ার বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবধানে জয় পায় ব্রাজিল। কিন্তু এরপরই যেন নিজেদের খুঁজে পায় সেলেসাওরা। একই প্রতিপক্ষকে এবার তারা ভাসায় গোলবন্যায়। ১৯৮১ সালের ইউরোপ সফরে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিকে হারিয়ে অনেকেরই কপালে ভাঁজের সৃষ্টি করেছিল সান্তানার ব্রাজিল।
তবে ব্রাজিল যেটা করছিল, সেটাকে ঠিক জয় বলা যায় না। কারণ, সেই ফুটবল যেন ছিল জয়েরও বেশি! পেলে পরবর্তী সময়ে সুশৃঙ্খল ট্যাকটিক্সের যে ফুটবলে ক্ষেপে গিয়েছিল ব্রাজিল সমর্থকেরা; সান্তানার দলের খেলার সেই মসৃণ স্টাইল যে তার থেকে কোনোভাবেই আর বেশি বৈপরীত্য ধারণ করতে পারতো না! আগের দু’টি বিশ্বকাপের ব্যর্থ মিশনের পর এবার সক্রেটিস, জিকোদের ফুটবল ছিল অনেকটাই ভিন্ন; যেখানে পাস দেয়ার আগে দু’বারের বেশি বল স্পর্শ করতে দেখা যেতো না কোনো প্লেয়ারকেই। জিকোর মতে, এই ওয়ান টাচ ফুটবল দেখতে যতটা ভালো লাগে, খেলতে গেলে তা উপভোগ্য হয় আরও বেশি। তিনি বলেন, এই প্লেয়িং স্টাইল সম্পর্কে আমরা বেশ অনমনীয় ছিলাম। এ কারণে এটা এতটা বিখ্যাত। ম্যাচের শুরুতেই ফলাফল নিয়ে ভাবা বা, হেরে যাওয়ার ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করাকে সোজাসাপ্টা ‘ভুল’ হিসেবেই দেখতাম আমরা। যা করছি, সেটাই কেবল উপভোগের চেষ্টা করতাম। বুঝতে পারতাম, দারুণ কিছু হচ্ছে।
সেটা ব্রাজিলিয়ানরাও বুঝতে পেরেছিল। রিওর পথেঘাটে সাধারণ মানুষের উন্মাদনা দেখে মনে হতে পারে, রাজকীয় বিয়ের যেন ক্ষণগণনা চলছে! এই জোয়ার আরও বেড়ে গেল যখন, সোভিয়েত ইউনিয়নকে নাটকীয়ভাবে ২-১ গোলে হারিয়ে স্পেনে ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ মিশন শুরু করলো ব্রাজিল। স্কটল্যান্ডকে ৪-১ ও নিউজিল্যান্ডকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিলো সেলসাওরা।
৬ গ্রুপে ৪টি করে দল নিয়ে মোট ২৪ দেশের লড়াই ছিল সেই বিশ্বকাপ। ৬টি গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্সআপ দল যাবে দ্বিতীয় গ্রুপ স্টেজে। সেখান থেকে শীর্ষ চার দল খেলবে সেমিফাইনাল। দ্বিতীয় গ্রুপ পর্বে ব্রাজিল পেলো আর্জেন্টিনা ও ইতালিকে। এর মাঝে ইতালি তাদের প্রথম রাউন্ডের তিনটি ম্যাচেই করেছে ড্র। আসর এগোনোর সাথে সাথে ইতালির বিবর্তনকে সূচিত করা যায় দলটির প্রধান স্ট্রাইকার পাওলো রসির সাথে। ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ১৯৮০ সালে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন রসি। আর এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয় বিশ্বকাপ শুরুর আট সপ্তাহ আগে। ম্যানেজার এনজো বেয়ারজো তাকে দলে না রেখেও পারেননি।
তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে স্পেন বিশ্বকাপে প্রথম জয় পায় ইতালি। আর ব্রাজিলও যখন আর্জেন্টিনাকে হারায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী দুই ফুটবল স্টাইলের দ্বৈরথের ক্ষেত্র হয়ে পড়ে প্রস্তুত। উজ্জীবিত ব্রাজিল মোটেও মাথা ঘামায় না ইতালিকে নিয়ে। দলের এক বৈঠকে কোচ সান্তানা বলে উঠেছিলেন, তোমরা ব্রাজিলের খেলোয়াড়। আর কিছু কেউ বলতে চাও?
তবে রোমায় খেলা মিডফিল্ডার ফ্যালকাও কিন্তু সম্পূর্ণ দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছিলেন না। এস্পানিওলের সারিয়া স্টেডিয়ামে হতে যাওয়া এই ম্যাচটি যে শতভাগ পরিকল্পনামাফিক যাবে না, এমনটাই মনে হচ্ছিল ইতালির ফুটবল সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা এই ব্রাজিলিয়ানের। হোঁচট খেয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করেছিল ইতালি। পরিচিত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই যে আসতে যাচ্ছে প্রবলতম বাধা, যা সম্পর্কে মোটেও সচেতন নয় তার সতীর্থরা-এই ভাবনাটাই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল ফ্যালকাওকে।
ইতালিয়ান লেফট ব্যাক আন্তোনিও ক্যাব্রিনি আক্রমণেও পারদর্শী। এছাড়া, ডিফেন্ডার ক্লদিও জেন্টাইল যে জিকোর সাথে আঠার মতো লেগে থাকবে, সে কথাটা টিম মিটিংয়েও তোলেন ফ্যালকাও। কারণ, জেন্টাইলকে একই ভূমিকায় দেখা গেছে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচেও। ম্যারাডোনাকে শক্ত মার্কিংয়ে রেখেছিলেন তিনি।
ব্রাজিলের শিহরণ জাগানিয়া আক্রমণাত্মক ফুটবলের ঠিক বিপরীতেই ছিল ইতালির দর্শন। তবে কাউন্টার অ্যাটাক যে তারা ভালোই পারে, সেটা দেখা গেছে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচে। তবে ব্রাজিলকে হারানোর জন্য ফ্রন্টলাইনকেও জ্বলে উঠতে হতো। আর দলের প্রধান স্ট্রাইকার পাওলো রসি তখনও আসরে গোলের দেখাই পাননি। ২০০৬ সালের এক সাক্ষাৎকারে রসি বলেছিলেন, ব্রাজিলের সেই দলটি মোটেও এই গ্রহের ছিল না। চোখ বাঁধা অবস্থাতেও তারা ঠিকঠাক পাস দিতে পারতো। আর আমি তখন কেবল নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে দলে ফিরে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি।
একদম উল্টো ছিল ব্রাজিল ক্যাম্পের অবস্থা। ফ্যালকাও তার দুশ্চিন্তার কথা প্রকাশ করে টিপ্পনিও খেয়েছেন সতীর্থদের কাছে। সবার দাবি, সিরি আ’ জেতা আর আমাদের কাছে এমন কী! পরবর্তীতে ডিফেন্ডার অস্কার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কয়েকজন খেলোয়াড় তো সেমিফাইনালে পৌঁছে যাওয়া পোল্যান্ডের শক্তিমত্তা-দুর্বলতা নিয়েই বেশি আলাপ করছিল!
গোল ব্যবধানে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকায় সেমিতে যেতে ড্র করলেই হতো ব্রাজিলের। তবে ম্যাচের আগে সান্তানা সবাইকে বলে দিয়েছিলেন, জয় ভিন্ন অন্য কোনো কথা ভাবা প্রকৃত ব্রাজিলিয়ানের ধর্ম নয়।
তবে বার্সেলোনায় ম্যাচটি শুরু হওয়ার পর ব্রাজিলের সমর্থকেরা যখন ঠিকঠাকমতো সিট খুঁজে বসতেই পারেনি, তার মধ্যেই ক্যাব্রিনি বাড়ালেন ভয়ঙ্কর এক ক্রস, যাতে মাথা ছুঁইয়ে গোল করে বসলেন রসি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইতালি এগিয়ে গেল ১-০ গোলে!
দ্রুতই সক্রেটিসের পায়ে সমতায় ফিরলেও ২৫ মিনিটে আবারও পিছিয়ে পড়ে ব্রাজিল। ব্রাজিলের ডিফেন্সের ভুলে ডি বক্সে পাওয়া আলগা বলকে জালে জড়ান রসি। ৬৮ মিনিটে সমতায় ফেরে সেলেসাওরা। উদযাপনে ফ্যালকাওয়ের চিৎকার প্রকাশ করে কেবল আনন্দই না, সেখানে জড়িয়ে ছিল চুইংগামে দমবন্ধ হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়ার স্বস্তিও।
২-২ ব্যবধানে ম্যাচটি শেষ হলেই হয়ে যেতো ব্রাজিলের। ম্যাচ শেষ হওয়ার যখন ১৫ মিনিটও বাকি নেই তখন খেলার ধারার বিপরীতে কর্নার পেলো ইতালি। আর ব্রাজিলকে স্তব্ধ করে দিয়ে হ্যাটট্রিক করে বসলেন পাওলো রসি! শেষ বাঁশি বাজানোর আগে ইসরায়েলি রেফারি আব্রাহাম ক্লেইন ইতালির আরও একটি গোলকে অফসাইড বলে বাতিল করেন। তবে তাতে আটকে থাকেনি ‘সারিয়া ট্র্যাজেডি’র মঞ্চায়ন।
অঘটনের ধারা এরপরও বজায় রেখে পোল্যান্ডকে টাইব্রেকারে হারায় ইতালি। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বসেরার খেতাব জিতে নেয় আজ্জুরিরা। তবে সেদিকে আর তাকাতে পারেনি ব্রাজিল। আটকে আছে সেই সারিয়া ট্র্যাজেডিতেই। স্মৃতি রোমন্থন করে জিকো বলেন, আমরা সবাই প্রচণ্ড হতাশ ছিলাম ফলাফল নিয়ে। কিন্তু কী হয়েছিল সেদিন, তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণাও ছিল। মর্যাদা নিয়ে খেলে পরাজয়ের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। এটা খেলারই অংশ। আমরা খালি হাতেই বাড়ি ফিরেছি। তবে শেষ পর্যন্ত এই দর্শনের ব্যাপারে কোনো সংশয় মনে দানা বাধেনি।
১৯৮২ সালের স্মৃতিগুলো নিয়ে ২০তম বার্ষিকীতে বই প্রকাশ করেছিলেন ফ্যালকাও। সেই ম্যাচের দিকে তাকানোর সাহস তার ছিল। ফ্যালকাও বলেন, সেই ম্যাচ হেরেছি, ঠিক আছে। তবে ইতিহাসে একটা জায়গা কি জয় করে নিইনি আমরা? বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেই ম্যাচের অংশ হতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ।
তবে সবাই এভাবে মেনে নিতে পারেনি। কারও কারও ক্ষত আরও গভীর; এমনকি হয়তো সক্রেটিসের চেয়েও! পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের এক শীতের রাতে, সেই ঘটনার ২২ বছর পরও শব্দ খুঁজতে খাবি খেতে হয়েছে ‘দ্য ডক্টর’কে। হাতের গ্লাসের দিক থেকে চোখ সরানোর ইচ্ছা তার ছিল না খুব একটা। বললেন, কী দারুণ এক দল ছিল আমাদের! অসম্ভব আনন্দ নিয়ে খেলছিলাম। তারপর তিনবার বল স্পর্শ করলো রসি, হ্যাটট্রিক করলো। আর যে ফুটবলকে আমি জানি, সেটা মরে গিয়েছিল সেদিনই।
সূত্র: বিবিসি
/এম ই
Leave a reply