মহিউদ্দিন মধু
বইয়ের দোকানে গিয়েছেন বই কিনতে, সেখানে পেয়ে গেলেন বই পড়ার একটু নিরিবিলি জায়গাও। সাথে যদি থাকে চা বা কফির কাপে চুমুক দেবার সুযোগ, তাহলে তো জমেই গেল? এমন সব সুবিধা নিয়ে রাজধানীতে খোলা হয়েছে ভিন্নধর্মী বইয়ের দোকান, দীপনপুর।
দীপনপুরের চৌকাঠ পেরিয়েই মনে হতে পারে, কোনো বাসার ড্রয়িংরুমে বুঝি ঢুকে পড়েছেন! ডানে তাকালে মনে হবে বাচ্চাদের খেলার মাঠ। বাঁ দিকে ঘাড় ফেরাতেই ভাবনায় পড়ে যাবেন, এটা কি বুকশপ না ক্যাফে? একটু সামনে এগুলেই মঞ্চ দেখে প্রশ্ন জাগতে পারে, সভা সেমিনারও হয় নাকি এখানে! এমন আবহে, রকমারি বইয়ের সমাহারে নিশ্চিতভাবেই ‘পাঠাগার গন্ধে’ মন ভরে উঠবে।
দীপনপুরের চৌকাঠ পেরিয়েই মনে হতে পারে, কোনো বাসার ড্রয়িংরুমে বুঝি ঢুকে পড়েছেন!
দীপনপুরে কফি কিংবা চা খেতে খেতে ভেসে বেড়ানো যাবে বইয়ের সমুদ্রে। জাগৃতি প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ফয়সাল আরেফিন দীপনের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে দীপনপুরে। দীপনের ব্যবহার্য চেয়ার-টেবিল, দীপনের লেখা, পুরস্কার, স্মৃতিস্মারক যত্ন করে সাজিয়ে রাখা আছে দীপনপুরে। মূলত, দীপনের স্বপ্নকে পূরণ করতেই দীপনপুরের যাত্রা।
প্রয়াত ফয়সাল আরেফিন দীপনের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে দীপনপুরে
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে প্রায় তিন হাজার বর্গফুট পরিসরে, ভিন্নধর্মী এই বুকশপে রয়েছে একটি শিশুতোষ কর্নার – ‘দীপান্তর’। এখানে পড়ার ফাঁকে একটু দৌড়-ঝাঁপও করে নিতে পারবে ছোট্ট শিশুরা। তেপান্তরের মাঠের মতো সবুজ ঘাসে ছাওয়া এই কোনায় বসে বই পড়বে শিশুরা, ইচ্ছে হলে বইয়ের পাতায় রং করবে। হৈ হুল্লোড় করে বই পড়ার আনন্দ নেবে। দীপনপুরের সুখস্মৃতি নিয়ে শিশুরা বড় হবে, আলোকিত মানুষ হবে এমনটাই স্বপ্ন উদ্যোক্তাদের।
দীপনপুরে পড়ার ফাঁকে একটু দৌড়-ঝাঁপও করে নিতে পারবে ছোট্ট শিশুরা
দীপনপুরে দেখা মিলবে একটা ছোট্ট মঞ্চেরও। নাম দীপনতলা। আলাপ-আলোচনা কিংবা ছোটখাট আয়োজন এখানেই সেরে নিতে পারবেন পাঠক-ক্রেতারা। সাহিত্য আড্ডা, প্রকাশনা উৎসব, আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসরের জন্য এই ব্যবস্থা।
সপ্তাহে দুই দিন (শুক্র ও শনিবার) দীপনতলায় শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রশিক্ষণের আয়োজন করার কথা জানালেন উদ্যোক্তারা। থাকবে শিশুদের জন্য গল্প বলার আসর এবং বরেণ্য ব্যক্তিদের সাথে শিশুদের মতবিনিময় সভা।
আলাপ-আলোচনা কিংবা ছোটখাট আয়োজন এখানেই সেরে নিতে পারবেন পাঠক-ক্রেতারা
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পুরো জায়গাটিতে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা একটু নিরিবিলি পড়তে চাইলে তাদের জন্য আছে ‘সিনিয়র সিটিজেন কর্নার’। আছে দুটি প্রার্থনা কক্ষ। পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তো বটেই, গ্রাহকের সুবিধার জন্য ফ্রি ওয়াইফাই-এর ব্যবস্থাও আছে এখানে।
প্রয়াত দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমান জলি এই বুকশপের স্বত্বাধিকারী ও প্রধান সমন্বয়ক। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই গ্রাহকের প্রয়োজন মতো আরো সুযোগ সুবিধা যোগ করতে। সে জন্যেই রাখা হয়েছে একটি মন্তব্য খাতা। গ্রাহক তার মন্তব্য কিংবা পরামর্শ লিখে দিতে পারবেন সেখানে। চাইলে দীপনপুরকে আপন ভেবে, তার সাজানো ভাবনার কথা জানাতে পারবেন। দীপনের প্রতি তাদের ভালবাসা ও মমত্ববোধের কথাও লিখতে পারবেন। যা আমরা সংরক্ষণ করে স্মারকগ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে সবাইকে জানাতে পারবো। দীপনের কয়েকজন বন্ধু এবং আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে দীপনের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তারই একটি উদ্যোগ হচ্ছে দীপনপুর।”
বই পড়ার আনন্দের সাথে রসনাবিলাস জুড়ে দিতে দীপনপুরের অন্যতম অংশ ‘ক্যাফে দীপাঞ্জলি’। বই পড়া, গল্প-আড্ডার সাথে থাকবে চা-কফি, জুস কিংবা হালকা খাবার। থাকবে ছোটদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা। অনেকেই ছুটি কিংবা অবসর সময়ে বুকশপে আসে; বই দেখতে বা পড়তে পড়তে হালকা কিছু খেতে ইচ্ছে করতেই পারে। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই ‘বুকশপ কাম ক্যাফে’র ভাবনা এসেছে বলে জানান রাজিয়া রহমান জলি। বলেন, ‘যেহেতু আমি একজন চিকিৎসক, তাই ক্যাফেতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের সাথে যুক্ত রয়েছে বিগ-ব্যাং এগ্রো ফার্ম এবং মিট-মনস্টার গ্রুপ। সুতরাং দীপনপুরে এলে আপনি পাবেন নিজস্ব ফার্মে উৎপাদিত মানসম্পন্ন দুধ-ঘি-মধুসহ আরো বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী।’
বই পড়া,গল্প-আড্ডার সাথে পাওয়া যাবে চা-কফি, জুস কিংবা হালকা খাবার
প্রয়োজনীয় বইটি খুঁজে না পেলে অর্ডার দিয়ে যাবেন, যথা সময়ে আপানার ঠিকানায় পৌঁছে দেবে দীপনপুরের কর্মীরা। অনলাইনেও অর্ডারের সুবিধা আছে এখানে। বিভিন্ন প্রকাশনীর নতুন বইয়ের পাশাপাশি পুরনো বইয়ের মজুতও আছে দীপনপুরে। পাবেন নতুন চিত্রশিল্পীদের আঁকা ক্যানভাস। সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠতে পারে স্বপ্নময় এক বুকশপ।
গল্পে গল্পে আবেগ আপ্লুত হয়ে জলি বলে উঠলেন, ‘সবাই জানে দীপনকে কী রকম নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তার স্মৃতিরক্ষার্থে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘দীপন স্মৃতি সংসদ’ থেকে আমরা দাবি করেছিলাম শাহবাগ থেকে কাঁটাবন পর্যন্ত সড়কের নাম ‘দীপন স্মরণী’ করা হোক এবং ২১ অক্টোবর জাতীয় প্রকাশনা দিবস করা হোক। কেউ সাড়া দেয়নি। আমার সন্তানেরা হয়তো তাদের বাবার হত্যার বিচার পাবে না। দীপনপুরের মধ্য দিয়ে আমরা দীপনের স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করব। আগামী প্রজন্ম যেন জানতে পারে তার কথা, তার আত্মত্যাগের কথা”।
প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের জন্ম ১২ জুলাই ১৯৭২ সালে। আলোকিত মানুষ, আলোর দিশারি দীপন ভালোবাসতেন দেশকে, ভালোবাসতেন বই। বিশ্বাস করতেন, মানুষের মেধা ও মননের ভিত্তি তৈরিতে ভালো বইয়ের বিকল্প নেই। সেই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ছাত্র জীবনেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সৃজনশীল ও মননশীল বই প্রকাশনার প্রতিষ্ঠান- জাগৃতি।
গত ২৫ বছর ধরে সুনামের সাথে প্রায় দুই হাজার বই প্রকাশ করেছে জাগৃতি । ৩১ অক্টোবর ২০১৫ সালে জাগৃতির কার্যালয়ে দীপনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে অন্ধকারের অপশক্তি। দীপনের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের সম্মলিত প্রচেষ্টা দীপনপুর। গত ১২ জুলাই দীপনের ৪৫-তম জন্মদিনে জন্ম হয় স্বপ্নময় এই বুকশপ ক্যাফের।
উদ্যোক্তাদের অন্যতম দীপনের বন্ধু তুষার আবদুল্লাহ। তিনি বলছেন- ‘আমরা চেয়েছি দীপনের স্মৃতিটুকু আমাদের মাঝে অমলিন থাকুক। দীপনপুরে আড্ডায় দীপনকে নিয়ে গল্প হোক, দীপনের প্রকাশ করা বই দীপনপুরে আলো ছড়াক। দীপনপুরে এসে শত ব্যস্ততা আর শত জটিলতা থেকে বেরিয়ে কিছুটা আনন্দময় সময় কাটুক শহরবাসীর। মাঝে মাঝে তরুণরা পথ হারিয়ে ফেলে, তাদেরকে আলো দেখাতে, একত্রিত রাখতেই এই আয়োজন।’
মানুষকে হয়তো মেরে ফেলা যায়। কিন্তু তার মননে যে স্বপ্নের বীজ বোনা থাকে তা একদিন ঠিকই বড় গাছ হয়ে ওঠে। একজন দীপন থেকেই জন্ম হয় একটা দীপনপুরের। শুধু একটা বুকশপের সীমায় একে বাঁধাটা ঠিক হবে না। এখান থেকেই হয়তো শান্তি-সহনশীলতার বার্তা নিয়ে ছড়িয়ে পরবে হাজারো স্বপ্ন, নতুন বোধে জেগে উঠবে আগামী সময়।
যমুনা অনলাইন: এমএম/টিএফ
Leave a reply