আর্জেন্টাইন গোলবারের নিচে বিশ্বস্ত নাম এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। ওপেন প্লে’র সাথে টাইব্রেকার- দুই জায়গায়ই এমিলিয়ানো দলের কাছে ভরসার নাম। তবে, পরের ক্ষেত্রে যেন রীতিমতো অবিশ্বাস্য এই গোলরক্ষকের পারফরমেন্স। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম এই নায়ক রুদ্ধশ্বাস ফাইনালেও ছড়ি ঘুরিয়েছেন স্পটকিকের সময়। গোল্ডেন গ্লাভস জয়ী এই গোলরক্ষকের ‘মাইন্ড গেম’ ব্যাখ্যা করেছেন নরওয়েজিয়ান স্কুল অব স্পোর্টস সায়েন্সেস’র অধ্যাপক জেইর হর্দে।
ফুটবল সাইকোলজির এই গবেষক টুইট করে বলেছেন, টাইব্রেকারে মাস্টারক্লাস পারফরমেন্স দেখিয়ে ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয় করেছে আর্জেন্টিনা। আর এই পারফরমেন্সের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন আলবিসেলেস্তে গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। জেইর হর্দে বলেছেন, সম্পূর্ণ পেনাল্টি বক্সেই আধিপত্য দেখিয়েছেন এমি। সেই সাথে, ফ্রান্সের দুইজন পেনাল্টি টেকারকে ভুল করতে বাধ্য করেছেন এই গোলরক্ষক। কীভাবে এমনটি করলেন এমি, সে ব্যাখ্যা ধাপে ধাপে দিয়েছেন ক্রীড়াবিজ্ঞানের এই বিশেষজ্ঞ।
ধাপ ১: প্রথমেই পেনাল্টি বক্সে চলে যান এমি, যেন সেটি একান্তই তার নিজের এলাকা। হুগো লরিস যখন মেসির সাথে কয়েন টস করছিলেন, তখনই গোলবারের দিকে হেঁটে যান এমি। অপেক্ষা করতে থাকেন লরিসের জন্য। তারপর লরিসকে স্বাগতও জানান পেনাল্টি বক্সে। ঠিক যেন, নিজ গৃহে অতিথিকে স্বাগত জানাচ্ছেন তিনি!
ধাপ ২: হুগো লরিস যখন পেনাল্টি বক্সে এসে পৌঁছান তখন করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন এমি। একই কাজ তিনি এমবাপ্পের সাথেও করেন। প্রথম সাক্ষাতে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ ও উষ্ণ আচরণ দিয়েই যেন প্রতিপক্ষ যোদ্ধাকে ঢাল নামিয়ে রাখতে বাধ্য করেন তিনি। রণকৌশল হিসেবে এরপরেই মারণ আঘাত হানেন এমি। দ্বিচারিতা দিয়ে যেন যুদ্ধাবস্থাই ঘোষণা করেন এমি।
ধাপ ৩: পেনাল্টি শুটআউটের প্রথম পর্যায়ে খুবই শান্ত ভঙ্গিতে খেলোয়াড়ের মনসংযোগে বিচ্যুতি ঘটানোর চেষ্টা করে যান এমি। সেই সাথে, রেফারির সাথে কথা বলেও বোঝার চেষ্টা করেন, তার সীমা ঠিক কতটুকু। এমবাপ্পে শট নেয়ার আগে এমি রেফারিকে কয়েকবার বলেন, বলটি ঠিক জায়গায় রাখা হয়েছে কিনা তা যাচাই করে দেখার জন্য। শেষে রেফারিও এমির ফাঁদে পা দেন; ‘থাম্বস আপ’ দেখিয়ে এমিকে ইঙ্গিত দেন, বল ঠিক জায়গায়ই আছে।
ধাপ ৪: কিংসলে কোম্যান যখন পেনাল্টি নিতে আসলেন, তখন এমি আরও জোর চেষ্টা চালান। রেফারিকে বিনীতভাবে অনুরোধ করেন, বলটি ঠিক জায়গায় বসানো আছে কিনা, তা পরীক্ষা করে নিতে। এতে তিনি পেনাল্টি এরিয়ায় নিজের দাপট আরও বেশি করে প্রকাশ করলেন। আর কিংসলে কোম্যানের পেনাল্টির ফলাফল কী ছিল, তা সবাই এখন জানে।
ধাপ ৫: পেনাল্টি সেভের পর গোলরক্ষকরা সচরাচর খুব উদ্দাম উদযাপন করে না। তবে এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম এমি মার্টিনেজ। কোম্যানের পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়ে বুনো উদযাপনে মাতেন এমি। আর গবেষণা দেখিয়েছে, খেলায় তীব্র উল্লাস জানান দেয় মাঠে আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব। এতে যেমন ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয় সতীর্থরা, তেমনি এই উদযাপন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে প্রতিপক্ষের উপর।
ধাপ ৬: অরেলিয়া শুয়ামেনি যখন পেনাল্টি নিতে এগিয়ে আসেন, তখন এমি মার্টিনেজ ঘটান আরেক কাণ্ড। তিনি বলটি নিয়ে নিজের গোলবারের দিকে এমনভাবে হাঁটতে থাকেন যেন, বলটি তারই! ওদিকে বলের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন শুয়ামেনি ও খোদ রেফারি! তবুও সময় নেন এমি। দর্শকদের দিকে এগিয়ে তিনি তাতিয়ে দেন সবাইকে যাতে উচ্চস্বরে শব্দ করে তরুণ শুয়ামেনিকে চমকে দেয় তারা।
ধাপ ৭: এরপর বল নিয়ে ফিরলেন এমি। শুয়ামেনিকে দেয়ার বদলে বল কিছুটা দূরে ঠেলে দেন এই গোলরক্ষক। রেফারিও কোনো ধরনের সতর্কতামূলক কথা বলেননি এমির উদ্দেশে। এতে প্রকাশ পায় দু’টি জিনিস। এক, পেনাল্টি এরিয়ার দখল রেফারি নয়, এমির কাছে। এবং দুই, শুয়ামেনির প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞা ও অসম্মান। তারপর যখন শুয়ামেনি বলটি রাখলেন শট নেয়ার উদ্দেশে, ফরাসি এই তরুণের দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞাসূচক হাসিও ছুঁড়ে দেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।
ধাপ ৮: আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার লিয়ান্দ্রো পারেদেস এরপর আসেন পেনাল্টি নিতে। লরিস নিতে পারেন এমির কৌশল, এমন ভাবনা থেকেই হয়তো আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক নিজেই বল নিয়ে এগিয়ে এসে তুলে দেন পারেদেসের হাতে। লরিসকে কোনো কৌশল অবলম্বনের সুযোগই দিলেন না এমি।
ধাপ ৯: ফ্রান্সের চতুর্থ পেনাল্টি টেকার কোলো মুয়ানি যখন আসেন, প্রথমবারের মতো সাইডলাইনের কোনো কোচিং স্টাফের সাথে কথা বলতে দেখা যায় এমিলিয়ানোকে। তারপর কোলো মুয়ানির দিকে তাকিয়ে এমি কয়েকবার বলেন, আমি তোমাকে দেখেছি। হলুদ কার্ড দেখাটা এ পর্যায়ে অবশ্যম্ভাবীই ছিল, আর হয়েছেও তা। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। টাইব্রেকারে এমি ফাইনালটা প্রায় জিতিয়েই দিয়েছেন আর্জেন্টিনাকে।
জেইর হর্দের ভাষায়, ফুটবলের ম্যাকিয়াভেলি হচ্ছেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। পেনাল্টি টেকারদের সাথে করা তার ‘মাইন্ড গেম’র প্রতিটি ধাপই যেমন পূর্বানুমানের অযোগ্য, তেমনি একদম হিসেব করা। অন্য গোলরক্ষকরাও এখন এমিকে অনুসরণ করতে চায়। কিংবা, প্রতিক্রিয়া হিসেবে কিছু না কিছু করার চেষ্টা করে থাকে। স্পোর্টস সায়েন্সেস’র এই অধ্যাপক বলেন, বিশ্বমঞ্চে এমন কৌশল আগামীতে কীভাবে আবারও মাঠে ফিরে আসে, তার প্রতিক্রিয়া কীভাবে প্রভাবিত করে ফুটবলারদের তা দেখতে আমি আগ্রহী।
/এম ই
Leave a reply