ডার্কওয়েবের নাম শুনেছেন নিশ্চই। ইন্টারনেট জগতের বিশাল এক রহস্যমোড়া দিক এটি। এই ডার্কওয়েবে প্রতি নিয়তই নানা রহস্যজনক বিষয় সামনে আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ও বহুল পরিচিত ঘটনা হলো ‘সিকাডা ৩৩০১’। এটি মূলত একটি ধাঁধাঁ, যা সমাধানের জন্য কোডিং, ক্রিপ্টোগ্রাফি থেকে শুরু করে শব্দের খেলাতেও অত্যন্ত দক্ষ হতে হবে। বহু কষ্টে অনেকে এ রহস্যের প্রায় কিনারায় পৌঁছলেও ডার্ক ওয়েবের এ রহস্য এখনো অন্ধকারেই রয়ে গেছে। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।
ঘটনার শুরু হয় ২০১২ সালের জানুয়ারিতে। ওই সময় ইন্টারনেটে ‘৪চ্যান’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ছবি পোস্ট করা হয়। ছবির সঙ্গে একটি লেখাও পোস্ট করা হয়। তাতে লেখা ‘আমরা একটি পরীক্ষা চালাচ্ছি। এই ছবির মধ্যে কিছু বার্তা লুকিয়ে রয়েছে। আমরা সে রকম কয়েক জন বুদ্ধিমান ব্যক্তির সন্ধান করছি, যারা ছবির ভেতর লুকিয়ে থাকা বার্তা খুঁজে বের করতে পারবেন।’ ছবিতে একটা প্রজাপতি ছিল আর ছিল ‘সিকাডা ৩৩০১’ লেখা। ছবিটি কম সময়ের মধ্যেই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। ডার্কওয়েবের এই জটিল ধাঁধার পেছনে কোনো সংস্থা রয়েছে, না কি মুখোশের আ়ড়ালে কোনো ব্যক্তি নিছক মজা করছেন, তা নিয়ে তোলপাড় হয়ে যায় ইন্টারনেট জগত। আর বিখ্যাত হয়ে পড়ে ‘সিকাডা ৩৩০১’ নামটি।
খালি চোখে ছবিটি থেকে কোনও বার্তা ধরা না পড়ায় অনেকেই বুঝতে পারেন যে, এই ধাঁধা সমাধান করতে হলে কোডিং, ক্রিপ্টোগ্রাফি থেকে শুরু করে শব্দ নিয়ে খেলার নিয়মকানুনেও পটু হতে হবে।
কারও কারও মতে, এই কাজের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাজেন্সি বা এনএসএ) অথবা মিলিটারি ইনটেলিজেন্স সেক্টর ৬ (এমআই ৬) সংস্থায় নিয়োগ করা হচ্ছে। যারা এই ধাঁধাগুলো সমাধান করে অন্তিম পর্বে জিতবেন, তাদের ওই সংস্থায় চাকরি দেয়া হবে। চাকরি দেয়া না হলেও কোনো বহুমূল্য পুরস্কার পেতে পারেন বিজয়ীরা।
অনায়াসে কোডিং করতে পারেন, এমন বহু ব্যক্তি ধাঁধার রহস্য সমাধানের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। তবে প্রথম ধাঁধার জবাব খুঁজতে গিয়েই হার স্বীকার করে নেন অনেকেই। ‘স্টেনোগ্রাফি প্রোগ্রাম’-এর সাহায্যে একটি সূত্র পান কোডাররা। কিং আর্থারের বই থেকে সূত্র অনুসরণ করেই একটি ফোন নম্বর বার করেন কোডাররা।
ওই নম্বরে ফোন করে যোগাযোগ করলে ও পার থেকে ভেসে আসে এক অদ্ভুত কণ্ঠস্বর। কথা বলার ধরন শুনে মনে হয়, তিনি উত্তর আমেরিকার বাসিন্দা। ফোনের ও পারে থাকা ব্যক্তিটি সবার প্রথমে শুভেচ্ছাবার্তা জানিয়ে কথা বলা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘প্রথম ধাঁধা সমাধান করে এত দূর আসার জন্য অভিনন্দন। আগেই ৩৩০১ নম্বরটি আপনাদের গোচরে এসেছে। পরবর্তী ধাঁধা সমাধান করে আরও দু’টি নম্বর খুঁজে বার করতে হবে। তার পর ৩টি নম্বর গুণ করে যা আসে, তার পর ডট.কম বসাতে হবে। সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে পরবর্তী ধাঁধা।
অজানা কণ্ঠস্বরের নির্দেশ অনুসরণ করে কোডারদের সামনে একটি মানচিত্র প্রকাশ্যে আসে। বিশ্বের মানচিত্রে পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকার পশ্চিম উপকূল ফুটে ওঠে। মানচিত্রে উঠে আসা সেই নির্দিষ্ট জায়গাগুলিতে গিয়ে কোডাররা দেখেন, সেখানে একটি পোস্টার লাগানো। প্রতিটি পোস্টারে আছে এক একটি ‘কিউআর কোড’। কোডটি স্ক্যান করলে প্রজাপতির মতো একটি চিত্র ভেসে আসে।
তার সঙ্গে ভেসে আসে ‘অ্যাগরিপা’ নামে একটি বইয়ের সূত্র। এই বইটি ছাপানোর সময় ‘ফোটোসেন্সিটিভ’ রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নাকি এই বইয়ের কালি উধাও হয়ে যাবে বলেও অনেকে মনে করেন।
কোডাররা একটি ফ্লপি ডিস্কও খুঁজে পান। সেখানে একটি কবিতা রয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো যে, এই কবিতাটি এক বার পড়া যাবে। এর পরে কেউ তা পড়তে চাইলে তাকে অতি অবশ্যই ‘ডেটা এনক্রিপশন’, ‘মিউজিক্যাল ক্রিপ্টোগ্রাম’ জানতে হবে।
কোডাররা এই সূত্রগুলোর সমাধান করে একটি ওয়েবপেজের লিঙ্ক খুঁজে বের করেন। সেই লিঙ্কে যাওয়ার পর প্রথম দফার বিজয়ীরা শুভেচ্ছাবার্তা পেলেও যারা নির্দিষ্ট সময়ের পর পেজে গিয়েছিলেন, তাদের জন্য অন্য বার্তা অপেক্ষা করছিল। সেখানে লেখা ছিল, ‘আমরা নেতা খুঁজছি, অনুসরণকারীদের নয়। আপনাদের খেলা এখানেই শেষ।
কয়েক দিন পর আবার একই ধরনের ধাঁধা পোস্ট করে ‘৪চ্যান’। তবে প্রথমটির থেকে এই ধাঁধাটি যেন আরও বেশি জটিল। এই ধাঁধা সমাধান করতে সফল হয়েছিলেন হাতেগোনা কয়েক জন। ২০১৭ সালে তৃতীয় ধাঁধা প্রকাশ্যে আসে। তিন ধাপে ধাঁধাগুলি সমাধান করার পর বিজয়ী হয়েছিলেন মাত্র ১ জন।
জোয়েল এরিকসন নামের সুইডেনের এক বাসিন্দা দাবি করেন, তিনি তিনটি ধাঁধা সমাধান করতে পেরেছেন। একটি ইমেলের ছবি ইন্টারনেটে পোস্ট করেছিলেন তিনি। জোয়েলের বক্তব্য, তিনি জেতার পর ‘৪চ্যান’-এর সদস্যদের তরফ থেকে তাকে এই মেল পাঠানো হয়।
মেলে লেখা ছিল, ‘আমরা একটি আন্তর্জাতিক দল। কিন্তু আমাদের কোনও নির্দিষ্ট নাম নেই। আমরা নিজেদের পরিচয় দিতে কোনও বিশেষ প্রতীকের ব্যবহারও করি না। আমাদের কোনও ওয়েবসাইট নেই। নিজেদের বিজ্ঞাপন করতেও বিশ্বাসী নই আমরা। আমাদের দলের সদস্যরা আলাদা ভাবে কাজ করেন। এই দলে থাকতে হলে একটি মাত্র নিয়ম মেনে চলতে হবে— তা হল এই দলের ব্যাপারে কাউকে কিছু জানানো যাবে না।’
পরে ‘ফাস্টকোম্পানি’কে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন জোয়েল। সাক্ষাৎকারে জোয়েল বলেন, ‘জয়ী হওয়ার পর আমি কোনো চাকরি পাইনি। আমাকে কোনো পুরস্কারও দেয়া হয়নি। এই পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে ধোঁয়াশা ছা়ড়া আর কিছুই নয়। শুরুর দিকে আমি মজার ছলেই ধাঁধাগুলো সমাধান করছিলাম। কিন্তু পরে বুঝতে পারি, এই জল অনেক গভীর। খরগোশের গর্ত খুব গভীর হয়, এক বার ঢুকে পড়লে মনে হয় আর শেষ হচ্ছে না। এই ধাঁধাগুলোও তেমনি আমি শুধু এতটুকু জানি যে, আমি কোনও একটি দলের সদস্য।’
এরপর আরও এক বার ইন্টারনেটে এমন ধাঁধা ছড়িয়ে পড়েছিল। এর নেপথ্যে আসলে কাদের হাত রয়েছে, তা জানার আগ্রহ থেকেই অনেকে ধাঁধা সমাধান করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে ধাঁধাগুলো এতই জটিল ছিল যে, কেউ তার সমাধান করতে পারেননি।
অধিকাংশের দাবি, বিদেশের কোনো নিরাপত্তা সংস্থা এই পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়োগ করছে। কিন্তু কেউ কেউ আবার এই দাবি অস্বীকার করেছেন। তাদের মতে, কয়েক জন হ্যাকার মিলে এই কাজ করেছেন। লক্ষ করা গিয়েছে যে, ধাঁধার সমাধান করার ধাপে যে সূত্রগুলি ব্যবহার করা হয়েছে তা অনেকটাই ব্রিটেন-ঘেঁষা। তাই হ্যাকাররা ব্রিটেনের বাসিন্দা বলে অনুমান একাংশের। কেউ আবার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তারা এই কার্যকলাপের সঙ্গে অনবরত যুক্ত রয়েছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ‘সিকাডা ৩৩০১’-এর নেপথ্যে কী রহস্য রয়েছে, তা রয়েছে অন্ধকারেই।
এসজেড/
Leave a reply