এমন কিছুই হবার কথা ছিল প্যারিসের রাতে। কাতার জয় করা আকাশি নীলের ট্যাঙ্গোর ছন্দ এবার আছড়ে পড়লো প্রেমের নগরী প্যারিসে। ২০২২ সালকে নিজেদের ইতিহাসে চিরভাস্বর করে নেয়ার পর ফিফা ‘দ্য বেস্ট’ পুরস্কারের রাতটাও নিজেদের করে নিয়েছে বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসি, লিওনেল স্কালোনি, এমিলিয়ানো মার্টিনেজের সাথে কার্লোস পাসকুয়াল- প্রতিটি নাম ঘোষণার সাথে যেন আতশবাজি পুড়েছে, কনফেত্তি উড়েছে বুয়েনস আইরেসের আকাশে।
লিওনেল মেসির জন্য এমন রাত নতুন নয়। বরং, ফুটবল ইতিহাসে দ্বিতীয় কোনো খেলোয়াড়ের কাছে এমন রাত এতটা চেনা পরিচিত ছিল না কখনোই। কিন্তু ফুটবলে মেসির আগমনের পর অনেক কিছুই আর আগের মতো থাকেনি। রেকর্ড বইয়ে রাজত্ব, ফুটবলীয় সমীকরণে নতুন করে দুর্লঙ্ঘনীয় সব সূত্রের সৃষ্টির সাথে সবুজ গালিচায় ফুটবল পেলো অনিন্দ্য সুন্দর ভাষা। তারপর ক্লাসের আদর্শ ফার্স্টবয় থেকে মরিয়া ক্লাস ক্যাপ্টেন হলেন লিওনেল মেসি। রোজারিওর ছোট্ট বালকের হৃদয়ে প্রবেশ করলো দিয়েগোর আত্মা! মেসির হাত ধরে আর্জেন্টিনায় ফিরলো সোনালি ট্রফি। দিনরাত একাকার করে আর্জেন্টাইনরা পেলো ট্যাঙ্গোর উপলক্ষ্য।
মেসির হাতেই পুরুষদের ‘ফিফা দ্য বেস্ট’ পুরস্কার ওঠার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন প্রায় সবাই। এই রাতে ফিফা ‘ফ্যান অ্যাওয়ার্ড’ জয় করা ৮২ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন প্রৌঢ় কার্লোস পাসকুয়াল যখন বললেন, খুব ভালো লাগছে, আমরা সব পুরস্কার জিতেছি- তখনও মেসির হাতে ওঠেনি সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। তবে, ১৯৭৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো বিশ্বকাপই মিস না করা এই আর্জেন্টাইন হয়তো মেসির পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহও করেননি। বর্ষসেরা পুরুষ কোচ হিসেবে লিওনেল স্কালোনি, বর্ষসেরা গোলরক্ষক হিসেবে এমিলিয়ানো মার্টিনেজের পর সেরা সমর্থক হিসেবে নিজে পুরস্কার জিতে যখন পাসকুয়াল দেখলেন, ৮টি ক্যাটাগরিতে অ্যাওয়ার্ড দেয়ার রাতে তিনটিই জিতে গেছে আর্জেন্টাইনরা, মেসি কি আর বাদ পড়েন!
গোলবারের প্রহরী হিসেবে ফুটবলের ‘এলিট’ ক্লাবে যাকে বছরখানেক আগেও বিবেচনা করা হতো না, সেই এমিলিয়ানো মার্টিনেজ জিতে নিয়েছেন ফিফার বর্ষসেরা গোলরক্ষক ২০২২’র পুরস্কার। কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটানোর পথে অ্যাস্টন ভিলার এই গোলরক্ষকের রয়েছে কিংবদন্তিসুলভ পারফরমেন্স। মেসি-স্কালোনিদের সাথে প্যারিসের আলো ঝলমলে রাতের তাই পাদপ্রদীপের আলো পড়লো এমির উপরও। জানালেন, আদর্শ হিসেবে মানেন তার উদয়াস্ত পরিশ্রম করা বাবা-মাকে।
এই রাতে জমকালো অনুষ্ঠানে পূর্ণতা পায় আর্জেন্টাইনদের ৩৬ বছরের অপেক্ষা ঘোচানোর অন্যতম কাণ্ডারি এমিলিয়ানো মার্টিনেজের স্বপ্নযাত্রা। আর্সেনালে বছর দশেক বদলি গোলরক্ষক হিসেবে খেলার পর অ্যাস্টন ভিলায় গিয়ে নিজ সামর্থ্যের অনুবাদ ঘটাতে সক্ষম হন এই আর্জেন্টাইন। এরপর গোলবারে বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবে জাতীয় দলকে জিতিয়েছেন কোপা আমেরিকা, লা ফিনালিসিমা। এরপর আসে বিশ্বকাপ। অমরত্ব অর্জনের সেই ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ এ হয় এমির শ্রেষ্ঠত্বের প্রদর্শনী। অবিশ্বাস্য কিছু সেইভের সাথে মিলে যায় বুদ্ধিদীপ্ত গেইম ম্যানশিপের। দুইটি পেনাল্টি শ্যুটআউটে এমির পারফরমেন্স যদি হয় অবিস্মরণীয়, লুসাইলে ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনালের অন্তিম মুহূর্তে কোলো মুয়ানির শট রুখে দেয়ার দৃশ্যকে বলা যাবে রীতিমতো অবিশ্বাস্য! কিংবদন্তিসুলভ পারফরমেন্সের স্বীকৃতি হিসেবে এমিলিয়ানো মার্টিনেজও কিছুটা কেড়ে নেন এই রাতে পাদপ্রদীপের আলো।
স্বর্গের সাথে করমর্দন করেছেন মেসি। ফুটবল দিয়ে এমিলিয়ানো দেখিয়েছেন জীবনযুদ্ধে আলো-আধারির খেলা। ট্রেডমার্ক বেস ড্রাম হাতে ১৯৭৪ সাল থেকে বিশ্বকাপের সকল আসরে আকাশি-নীলের স্বপ্নসারথী কার্লোস পাসকুয়ালের প্রাপ্ত স্বীকৃতি। এ সবকিছুরই বোধহয় নেপথ্য নায়কের নাম লিওনেল স্কালোনি। ২০১৮ বিশ্বকাপে হতাশার পর লিওনেল মেসিকে ঘিরে নতুন করে দল গঠন, কিংবদন্তিদের কাছ থেকে অপমানজনক বাক্য গিলে ফেলে দলের মাঝে স্বপ্ন বুনে দেয়া- লিওনেল স্কালোনির সাফল্যগাঁথা অনেকটাই যেন রূপকথার মতো শোনায়। কাতার বিশ্বকাপে সৌদি আরবের সাথে হেরে যাত্রা শুরুর পর প্রতি ম্যাচেই প্রতিপক্ষ বিবেচনায় নিজ দলের কৌশল পরিবর্তনের মাধ্যমে স্কালোনি দেখিয়েছেন, মেসি-নির্ভরতা সত্ত্বেও আর্জেন্টিনার পুরো দলটি নমনীয়তার বিচারে কতটা বিশ্বমানের। বিশ্বকাপ জিতে স্কালোনি পেয়েছেন জীবনের অন্যতম সেরা পুরস্কার। এবার পেলেন ফিফার স্বীকৃতি। বললেন, কাছের মানুষ, নিজের দেশের মানুষকে খুশি দেখার চেয়ে মহিমান্বিত আর কিছুই হতে পারে না। এই মুহূর্তটি অমূল্য। এই জয় সকল আর্জেন্টিনাবাসীর।
২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাতে পৃথিবীর গাঢ়তম আঁধারই হয়তো বাসা বেধেছিল প্যারিসের আকাশে। আলবিসেলেস্তেদের উৎসব শুরুর রাতটা যেন নীরবতার নামান্তর ছিল ফরাসিদের স্বপ্নভঙ্গে। এবার আর্জেন্টাইন তারকাদের দ্যুতি ছড়ানোর রাতে, পাসকুয়ালদের বেস ড্রামসের বিটে নিজেদের আনন্দ খুঁজে নিতে পারে প্যারিস। দাঁত দিয়ে কাঁটাসহ গোলাপ কামড়ে ধরে সঙ্গীর দিকে মদিরা মেশানো দৃষ্টিতে তাঁকানোর যে চুম্বকার্ষণ, সেই ট্যাঙ্গোর ছন্দ যেন জয় করে নিলো ছবি, কবিতা ও প্রেমের রাজ্য।
/এম ই
Leave a reply