‘নারী দিবস আসুক নারী মুক্তির বার্তা নিয়ে’

|

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে নারীর অধিকার রক্ষা করা সম্ভব নয়। নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। নানান সামাজিক প্রথা, আইন, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা, প্রযুক্তির অপব্যবহার, বিচারের ধীরগতি এবং সুশাসনের অভাব নারীর অগ্রযাত্রায় প্রধান অন্তরায়। অধিকার সুরক্ষায় তাই নারীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা বিশেষ প্রয়োজন। সর্বস্তরে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে নারীর অধিকার রক্ষা করা সম্ভব নয়। সামাজিক মূল্যবোধ আর আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না।

বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আমরা গলা উঁচু করে নির্দ্বিধায় নারী স্বাধীনতার কথা বলে থাকি, কিন্তু আমরা আসলে নারী স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বুঝি না। নারী পরাধীনহেতু সমাজ ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করা হলেও নিজেদের দুর্বলতাও কম দায়ী নয়। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে তাকে অবশ্যই সংযম হতে হবে।

নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। নারীর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে কোনরূপ বাধা দেয়া যাবে না। প্রাথমিক হয়ে উচ্চশিক্ষা থেকে চাকরির ক্ষেত্রে সর্বত্রই নারী পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি অসম্মানবোধ, সম্ভ্রমহীন এবং শত্রুভাবাপন্ন প্রতিযোগী মনোভাব দূর করতে হবে। পুরুষের পাশাপাশি সকল ক্ষেত্রে নারীর সমসুযোগ ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করলেই জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।

১৯১০ সালের ৮ মার্চ ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে অনুষ্ঠিত এক নারী সম্মেলনে জার্মানির এক নারী নেত্রী কারা জেটকিন দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এর পরের বছর ১৯১১ সালের ৮ মার্চ ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর থেকেই মূলত বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে।

নারী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ভাবনাগুলো তুলে ধরেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমন ইসলাম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নামজমুন নাহার রোমানা বলেন, বর্তমান বিশ্ব ও ডিজিটাল বাংলাদেশর প্রেক্ষাপটে নারীরা বেশ এগিয়েছে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান আরও জোরদার করা প্রয়োজন। এই যে, এখনো গ্রামীণ পর্যায়ে নারী রয়েছেন যারা পুরুষদের মতো ক্ষেতখামারে কাজ করছেন, চা বাগানে দিনের পর দিন না খেয়ে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ফলে নারীরা তাদের পর্যাপ্ত অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন, বঞ্চিত হচ্ছেন খাদ্য থেকে। এছাড়াও শহরের কথা বলতে গেলে, দেখা যাচ্ছে তারা এখনো এই সময়ে এসে রাস্তা ঘাটে ইট-খোয়ার কাজ করছেন। কিন্তু কেন? নারী ঘরের বাইরে কাজ করবে, তবে তাই বলে কি সেই কাজ- যে কাজ পুরুষের করা দরকার?

তিনি বলেন, নারী-পুরুষ সমাধিকারের কথা বলা হলেও পুরুষদের মতো করে নারীদের এখনো দেখা হয় না কিংবা মর্যাদা দেয়া হয় না। আমরা নারী জাতি, এই সময়ে এসে দাবি- পুরুষদের মতো সমমর্যাদায় আসন দেয়া হোক। কোমলমতী নারীদের সেই সুবিধা দেয়া হোক যাতে নারীরাও পুরুষের মতো কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

ছবি: নামজমুন নাহার রোমানা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী মো. উমর ফারুক বলেন, নারী ও পুরুষের সমতার কোনো বিকল্প নেই। প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। দিনটি লিঙ্গ সমতা, প্রজননের অধিকার, নারীদের ওপর হিংসা ও নির্যাতন, নারীর সমান অধিকার ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও এ দিনটিতে নানা আয়োজন থাকে। যখন বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশ নারী প্রধানমন্ত্রীর সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সবক্ষেত্রেই নারীদেরও ভূমিকা কমতি নেই তবুও একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন দেখি পুরুষদের তুলনায় নারীদের মূল্যায়ন কম করা হয় তখন আমরা প্রশ্নের মুখোমুখি হই। এখনো সমান কাজ করেও পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় নারী শ্রমিকদের কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়, তখন সমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। একটা দিক স্পষ্ট আমরা সবসময় মেয়েদের অবহেলার চোখে দেখি, মনে করি ওরা দুর্বল, সমাজ তাদের টেনে নামিয়ে দেয়, বাধ্যবাধকতার বেড়াজালে আবদ্ধ করে রাখে। কিন্তু দেখুন আমাদের দেশে শিক্ষায় মেয়েরা দিনদিন ছেলেদের থেকেও এগিয়ে যাচ্ছে। নারীরা আজ সাফ জয় কিংবা ক্রিকেটে এশিয়া কাপ জয় করে দেশের সম্মান বয়ে আনছে। আমাদের উচিত নারীদের পাশে থেকে সমর্থন করা। তাই আমি মনে করি নারীদের অবহেলা নয় মর্যাদা দিয়ে অনুপ্রাণিত করা উচিত। নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে এ দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

ছবি: মো. উমর ফারুক

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী বৃষ্টি খাতুন বলেন, আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থার সর্বোত্তম রাষ্ট্র শাসন প্রণালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্বীকৃত। এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিকাশ নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করে। বর্তমান নারী সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পুরুষের তালে তালে সমান অবদান রাখছে। কিন্তু পূর্বে নারীদের ‘অবলা’ মনে করা হতো এবং অবহেলা, অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হতে হতো। উদাহরণস্বরূপ নারী অবহেলার চিত্র: স্কুল ফিরতি মেয়ে তার বাবাকে বলতো, ‘ভাইয়ের বেলায় ম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর আমার বেলায় বাংলা, ভূগোল, হিস্ট্রি’।

তিনি আরও বলেন, কালের আবর্তনে সময়ের ব্যবধানে নারীরা আজ নিজগুণে প্রতিষ্ঠিত। তবুও নারীদের নানা বৈষম্যর চিত্র এখনো দেখা যায়। নারী দিবসে এসে বলতে চাই, বৈষম্যহীন সমাজ, সম মর্যাদাপূর্ণ বিকাশশীল সমাজের জন্য নারী ও পুরুষ সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।

ছবি: বৃষ্টি খাতুন

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সালমা আক্তার বলেন, নারী শুধু নারী নয়, নারীও একজন মানুষ। সমাজ নারীকে নারী হিসেবে দেখে মানুষ হিসেবে নয়। সময় এসেছে চিন্তার পরিবর্তনের। নারী মানে সে লাজুক, কোমলমতী, দুর্বল নয়। নারী মানেই সে তো পুতুল নিয়ে খেলবে, সে সংসার করবে, যে বাচ্চা মানুষ করবে, সবার দেখাশোনা করবে। এগুলো সমাজের তৈরিকৃত যা নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য।

তিনি আরও বলেন, নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মিড তার Culture and personality থিওরিতে দেখিয়েছেন, আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি নির্ধারণ করে দেয় আমাদের আচরণ। যেখানে ঠিক করা থাকে নারী কোন কাজগুলো করবে, তার আচরণ কেমন হবে। সমাজে একজন পুরুষ কোন কাজগুলো করতে পারবে, তার আচরণ কেমন হবে। আধুনিকতার যুগে এসেও আমাদের চিন্তার পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়নি আমাদের গতানুগতিক সংস্কৃতির। যেখানে নারী মানে অবহেলিত, তার সাথে যা ইচ্ছে ব্যবহার করা যায়। নারীকে নিয়মের বেড়াজালের মধ্যে আটকে রাখা যায়। কিন্তু সময় এসেছে আমাদের এ চিন্তা পরিবর্তন করার। নারীর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা নারীকে দিতে হবে। কাজের সুযোগ দিতে হবে। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে।

ছবি: সালমা আক্তার

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী একা রায় বলেন, ছোট বেলা থেকেই একটা কথা শুনে এসেছি ‘অবলা নারী’। নারীদের কথায়, কাজে কীভাবে অসহায় বানিয়ে রাখা হতো এই চিত্রই হয়তো এটা দিয়ে প্রকাশ পায়। যুগ পাল্টাচ্ছে, পালটাচ্ছি আমরা। ছেলেদের কাজ, মেয়েদের কাজ এই ধারণা থেকে আমরা মোটামুটি বেড়িয়ে আসছি। এখন অসহায়ত্বের ধার না ধেরে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রেই নারীরা এগিয়ে চলেছে সমান গতিতে। এই এগিয়ে চলা শুধু ‘নারী দিবস’ নামক একটি দিনকে কেন্দ্র করে শুভেচ্ছা বিনিময়ে সীমাবদ্ধ না থাকুক এমনটাই প্রত্যাশা থাকবে।

ছবি: একা রায়

ইমন ইসলাম
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply