শ্রেণিকক্ষে আটকে বাবা-ছেলেকে নির্মম নির্যাতনের নেপথ্যে কী?

|

ফরিদপুর প্রতিনিধি:

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার জাহাপুরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে আটকে রেখে ১৫ বছর বয়সী এক দিনমজুর কিশোর ও তার চল্লিশোর্ধ বাবাকে নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুটি মামলার খবর পাওয়া গেছে।

একটি মামলা হয়েছে ওই নির্যাতনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে। যেই মামলায় ইতোমধ্যে তিনজন আসামি জামিন পেয়েছেন। তবে প্রধান আসামি এখনো কারাগারে রয়েছেন। অপরদিকে নির্যাতনের শিকার ওই ছেলের বিরুদ্ধে সৎ মেয়েকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে দায়েরকৃত অন্য মামলাটির বাদী তার বাবা। তবে ছেলের বিরুদ্ধে এই যৌন নির্যাতনের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলা সম্বন্ধে তার বাবা কিছু জানেন না বলে সাংবাদিকদের জানান তিনি।

সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, স্কুলের শ্রেণিকক্ষে একজন নারীর নেতৃত্বে এক বাবা ও তার ছেলেকে পিটিয়ে ও মেরে নির্যাতন করছেন এক যুবক ও উঠতি বয়সী কয়েক তরুণ। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওর ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৭ মার্চ ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার জাহাপুর ইউনিয়নের আড়ুয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে তালা দিয়ে ওই দু’জনকে নির্মম নির্যাতন করা হয়।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নির্যাতনের শিকার দু’জন হলেন- কামারখালী ইউনিয়নের সালামতপুর (বর্তমান রউফনগর) গ্রামের ইয়ামিন মৃধা রাজু (৪০) ও তার ছেলে রাজন মৃধা (১৫)। নদী ভাঙনে ভিটামাটি হারিয়ে প্রায় ১২ বছর তারা মাঝকান্দি গ্রামে মো. সালাম শেখের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করে আসছেন। নিজের মেয়ে ও বোনকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তুলে তাদের নির্যাতন করা হয়।

এ বিষয়ে ইয়ামিন মৃধা রাজু বলেন, আমার ৯ বছর বয়সী মেয়ে আড়ুয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। ওই স্কুলের স্কুলশিক্ষক ইসরাত জাহান লিপির কোনো সন্তান নাই। তিনি আমার মেয়েকে লোভ-লালসা দিয়ে তার কাছে নিয়ে রাখতে চান। অনেকদিন ধরে এ চেষ্টা করছেন। এর আগেও তিনি আমার মেয়েকে আমাদের না জানিয়ে তার বাসায় নিয়ে গেছেন। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেয়েকে তার বাসায় পেয়েছি।

ইয়ামিন মৃধা অভিযোগ করে বলেন, গত ১৭ মার্চ আমাকে ও আমার ছেলেকে স্কুলে ডেকে নিয়ে লোকজন দিয়ে প্রথমে ভয়ভীতি দেখিয়ে আমার মেয়েকে স্ট্যাম্পে লিখে দিতে বলেন। রাজি না হলে আমার ছেলের নামে মিথ্যা অভিযোগ তুলে নির্যাতন করেন। আমার উপরেও নির্যাতন করা হয়।

এদিকে নির্যাতনের শিকার বাবা ও ছেলেকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারের পর তাদের থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর ২১ মার্চ একই দিন শিশুটির সৎ বাবা তার ছেলেসহ তাকে মারধরের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এ মামলায় তিনজনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৭/৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মো. কুতুবউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

মধুখালী থানা পুলিশ জানায়, একইদিনে ইয়ামিন মৃধা তার ৯ বছরের এক শিশুকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে ছেলেকে আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলায় ছেলে রাজন মৃধাকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে
পাঠানো হয়েছে।

তবে ইয়ামিন মৃধা জানান, আমি ছেলের বিরুদ্ধে আমার সৎ মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে কোনো মামলা করিনি। স্কুল শিক্ষিকা ইসরাত জাহান লিপি পরিকল্পিতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে এ মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নির্যাতন চালিয়েছে। এরপর দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, আমাকে ও আমার ছেলেকে সেদিন উদ্ধারের পর মধুখালী থানায় নিয়ে পুলিশ দুটি কাগজে স্বাক্ষর নেয়। আমি লেখাপড়া জানি না। তাই সেখানে কী লেখা ছিল আমি জানি না। তবে ছেলের বিরুদ্ধে মেয়েকে ধর্ষণের কোনো অভিযোগ নেই আমার। এসবই তাদের সাজানো বলেও জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, অভিযোগ শুধু আমার ছেলের বিরুদ্ধেই নয়, প্রথমে তারা আমার বিরুদ্ধেও মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ করেছিল। আমার মেয়ে এখন আমার ভাইয়ের বাড়িতে আছে। সে তার ওপর আনিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে তাকে মিথ্যা কথা বলতে শিখিয়ে দেয়া হয়। সে তার জবানবন্দিতে আমার ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সঠিক নয় বলেও জবানবন্দি উল্লেখ করেছে।

এ ব্যাপারে আড়ুয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইসরাত জাহান লিপি বলেন, ওই ছাত্রী আমাদের স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার মা নেই। বাবা ও ভাই জুটমিলের শ্রমিক। কয়েকমাস আগে সে জানায় তার বাবা ও ভাই তাকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করে। ১৫ থেকে ২০ দিন আগে সে আমার সাথে ফরিদপুরের বাসায় চলে আসে। এরপর তাকে বুঝিয়ে তার বাবা-ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেই।

লিপির দাবি, এরপর নির্যাতনের ভয়ে গত ১৪ মার্চ আবার মেয়েটি তার বাসায় চলে আসে। ১৭ মার্চ তার বাবা-ভাইকে স্কুলে ডেকে আনা হয় বিষয়টি জানার জন্য। এ সময় স্থানীয়রা বিষয়টি জেনে সেখানে চলে আসে। পরে স্কুলের একটি কক্ষের মধ্যে বহিরাগতরা তাদের মারধর করে। তবে নির্যাতনকারীদের আমি চিনি না।

এ ব্যাপারে মধুখালী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, অতি শিগগিরই এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ফরিদপুরের পুলিশ সুপারের সাথে কথা বলেছি। এ ঘটনায় ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা ও শিক্ষকরা জড়িত আছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখা হবে।

মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শহিদুল ইসলাম জানান, গত শুক্রবার (১৭ মার্চ) দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে একটি স্কুলের শ্রেণিকক্ষে আটকিয়ে নির্যাতনের পর পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। এ ঘটনায় গত সোমবার মধুখালী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার প্রধান অভিযুক্ত কুতুবউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া একইদিনে ছেলেকে আসামি করে ধর্ষণের অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন মেয়েটির সৎ বাবা। ওই মামলায় ওই কিশোরকে গ্রেফতার দেখিয়ে গত ২২ মার্চ আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি শিশুটির শারীরিক পরীক্ষা করানো হয়েছে এবং শিশুটি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।

ইউএইচ/


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply