রিফাত-বিন-ত্বহা
শুধু রঙ তুলির স্পর্শে তিনি সৌন্দর্য অন্বেষণ করেননি, বাস্তবেও প্রমাণ দিয়েছেন ভালবাসার। তাই ঢাকার ফুটপাত থেকে দুর্লভ নাগালঙ্গম বৃক্ষ নিধন হতে দেখে তার চোখ প্লাবিত হয়েছিল। বলতেন, এতো একটি বৃক্ষের নিঃশেষ নয়, গোটা জীবনের পরিসমাপ্তি। সেই মহান মানুষটি হলেন শিল্পী এসএম সুলতান। পুরোনাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। তবে নড়াইলবাসীর কাছে তিনি ‘লাল মিয়া’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। আজ ১০ আগস্ট শুক্রবার । বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ৯৪ তম জন্মদিন ।
এই শিল্পী জন্মেছিলেন সবুজ স্নিগ্ধতায় ছাওয়া নড়াইলের উপকণ্ঠে। ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট। পিতা ছিলেন সামান্য রাজমিস্ত্রী। তাই সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনের আবহ শিল্পী পেয়েছিলেন শৈশবেই। স্কুলে পড়ার সময় ড . শ্যামা প্রসাদের বক্তব্যরত ছবি একে প্রশংসা পেয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতা যান। ৪১-এ ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে। ৪শ’ প্রতিযোগির মধ্যে ভর্তি পরীক্ষায় অঙ্কন এ প্রথম স্থান অধিকার করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাঁধা ধরা গন্ডি তাঁর কাছে ছিল আকর্ষণহীন। ৪৩-এ সেখান থেকে পলায়ন। সারা ভারত পরিভ্রমণ। আর এ সময় অজস্র ছবি আঁকার কাজও চলে। ৪৪-এ সিমলায় একক চিত্র প্রদর্শনী। দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী হয় ৪৬ সালে। লাহোর ও করাচিতে একক চিত্র প্রদর্শনী ৪৭ ও ৪৮ এবং ৪৯-এ। করাচিতে ‘ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন’ আয়োজিত (১৯৪৯) ৪৫টি দেশের শিল্পীরা চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নেন। এরমধ্যে শিল্পী সুলতানের ছবি শ্রেষ্ঠ হিসেবে পুরস্কৃত হয়। কিন্তু একদিন সেখানে ৪শ’ ছবি রেখে আবার পৃথিবীর পথে বেড়িয়ে পড়া।
১৯৫০ সালে লন্ডন গমন। সেখানে ৪টি একক চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। পরের বছর নিউইয়র্ক এ পাবলো পিকাসো, সালভ্যাদও দালী, র্যাবেথ ক্লি প্রমুখ শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের চিত্রকর্মের সাথে সুলতানের চিত্র কর্ম প্রদর্শনী হয়। দেশে আসেন ১৯৫৩ সালে।
নড়াইলে পরের বছর নন্দনকানন আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৯ এ চারুকলা ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠার সাথে ছিলেন। যশোরে একাডেমি অব ফাইন আর্টস প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৩ সালে। বর্তমানে যা চারুপীঠ।
বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে শিল্পী সুলতানের একক চিত্র প্রদর্শনী হয়। ১৯৮১ সালে শিল্পকলা একাডেমির আবাসিক আর্টিষ্ট হিসাবে মনোনয়ন পান তিনি। ঢাকাতে দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী হয় ১৯৮২ সালে। ওই বছরই নড়াইলে শিশু স্বর্গ’র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে তাকে বিশ্বের সেরা কৃতি মানব হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়।
এরপর ঢাকার জার্মান কালচারাল ইন্সটিটিউটে তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী হয় ১৯৮৭ সালে। ১৯৮৮ সালে তিনি পান একুশে পদক। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় আর্ট খ্যাতনামা শিল্পীদের পাশাপাশি সুলতানের চিত্রকর্মও প্রদর্শিত হয়।
ক্ষণজন্মা চির কুমার বরেণ্য এই শিল্পী ছবি একেঁছেন দু’হাতে। ব্যবহার করেছেন দেশজ ও লতাপাতা শেকড়ের নির্যাস থেকে সংগৃহিত রঙ। মোট ছবির সংখ্যা তিনি নিজেও জানতেন না। তবে লক্ষাধিক হবে। যা তিনি কখনও সংরক্ষণের তাগিদ অনুভব করেননি। যাঁকে খুশি তাঁকে দিয়েছেন অকাতরে।
নড়াইলে তাঁর শিশু স্বর্গ, যেখানে বাস করতেন, সেখানে বৃক্ষ এবং দুর্লভ ফুলে ভরা ছিল। ছিল বহু পাখি ও জীব জন্তু। তাদের নিজ হাতে তিনি সেবা করতেন। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর অসুস্থ অবস্থায় যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রিয় জন্মভূমি নড়াইলের কুড়িগ্রামে তাকে শায়িত করা হয়।
এ বছর দিবসটি পালন উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও সুলতান ফাউন্ডেশন নড়াইলে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শিল্পীর মাজার জিয়ারত, মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, কোরআনখানি, দোয়া, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও আলোচনা সভা।
Leave a reply