অ্যানফিল্ডে লিভারপুলের সাথে ড্র করেই যেন আর্সেনালের সামনে লিগ শিরোপার কাছে গিয়েও হারিয়ে ফেলার অশনি সংকেত। কারণ, গায়ে গা লাগিয়ে ছুটছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটি। পুরো মৌসুম জুড়েই নিঃসন্দেহে দুর্দান্ত খেলছে গানাররা। কিন্তু অলরেডদের বিরুদ্ধে দুই গোলের লিড ধরে রাখতে না পারার কারণে চড়া মাশুল গুনতে হতে পারে মিকেল আর্টেটার দলকে। গোল ডটকমের প্রতিবেদন মতে, আর্সেনাল নয়, এবারও শিরোপা জিততে যাচ্ছে গত পাঁচ মৌসুমে চারবারই লিগ জেতা পেপ গার্দিওলার ম্যান সিটি। সেখানে ৫টি কারণ ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, এসবের জন্যই মূলত হতে যাচ্ছে না গানারদের ১৯ বছরের প্রতীক্ষার অবসান।
অনভিজ্ঞ স্কোয়াড:
ম্যান সিটি স্কোয়াডের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে বিজয়ীদের ছড়াছড়ি। কেভিন ডি ব্রুইনা, ইলকায় গুন্দোয়ান, বার্নাদো সিলভা, রিয়াদ মাহরেজ, জন স্টোনসরা আগেই জিতে ফেলেছেন বেশ কয়েকটি লিগ শিরোপা। এরকম চাপের মুহূর্তে কীভাবে সেরা পারফরমেন্স দিতে হয়, সেটা তারা ভালোই জানেন। পেপ গার্দিওলার দলে খেলে যাওয়া গ্যাব্রিয়েল জেসুস ও অলেক্সান্দর জিনচেঙ্কো এবার আছেন আর্সেনালে।
কিন্তু এই দুইজন ছাড়া গানারদের পুরো স্কোয়াডে কারোরই নেই প্রিমিয়ার লিগ জয়ের অভিজ্ঞতা। আর্সেনাল গোলরক্ষক অ্যারন রামসডেল যেমন গত মাসে এভারটনের বিরুদ্ধে ৪-০ গোলে জয়ের পর বলেছিলেন, আমরা জানি না কীভাবে এই চাপ সামলাতে হয়। তাই আমরা এমনভাবে ম্যাচ খেলতে যাই যেন, আমরা পয়েন্ট টেবিলের ১০ বা ১২ তম দল।
হাল্যান্ড ফ্যাক্টর:
১৪ গোল নিয়ে এ মৌসুমে আর্সেনালের সর্বোচ্চ গোলদাতা গ্যাব্রিয়েল মার্টিনেল্লি। বুকায়ো সাকার গোল ১৩। এছাড়া মার্টিন ওডেগার্ডের নামের পাশে এ মৌসুমে আছে ১০টি গোল। গ্যাব্রিয়েল জেসুস ইনজুরিতে লম্বা সময় মাঠের বাইরে না থাকলে তার নামের পাশেও হয়তো থাকতো দুই অঙ্কের গোলসংখ্যা। কিন্তু তারা কেউই আসতে পারছেন না আর্লিং ব্রড হাল্যান্ডের পাশে।
শনিবার সাউদাম্পটনের বিপক্ষে ম্যাচে চলতি মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে নিজের গোলসংখ্যাকে ৩০’এ নিয়ে গেছেন ম্যান সিটির এই গোলমেশিন। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এই নরয়েজিয়ানের গোল চলতি মৌসুমে ৪৪। প্রিমিয়ার লিগের এক মৌসুমে মোহামেদ সালাহর করা ৩৪ গোলের রেকর্ডও হয়তো সহজেই ভেঙে ফেলবেন হাল্যান্ড। বলাই বাহুল্য, বিশ্ব ফুটবলে এখন অন্যতম ভয়ংকর স্ট্রাইকারও তিনি। তার উপস্থিতিই ম্যান সিটিকে দিচ্ছে বাড়তি সুবিধা ও আত্মবিশ্বাস। পেপ গার্দিওলা কিছুদিন আগেই বলেছিলেন, মেসি ও রোনালদোর অবিশ্বাস্য দুই দশক আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এখন মনে হয়, হাল্যান্ডও সেই উচ্চতায় যাচ্ছে।
দলে হাল্যান্ড থাকার পরও ম্যান সিটি প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতবে না, এর পক্ষে বাজি ধরার লোক হয়তো এখন খুব বেশি নেই।
ঝাকার হুট করে ক্ষেপে যাওয়া:
‘লড়াইয়ের মনোভাব রাখতে হবে। তবে বুঝতে হবে আপনি কখন একটি ভালুককে বিরক্ত করবেন আর কখন তাকে ঘুমোতে দেবেন। সে বড্ড ভুল সময়ে ভালুককে বিরক্ত করে।’- স্কাই স্পোর্টসের সাথে আলাপচারিতায় আর্সেনাল মিডফিল্ডার গ্র্যানিট ঝাকার হুট করে ক্ষেপে যাওয়ার প্রসঙ্গে এমন মন্তব্য করেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক তারকা রয় কিন।
লিভারপুলের বিরুদ্ধে ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার সময় ম্যাচের পুরো নিয়ন্ত্রণই ছিল আর্সেনালের হাতে। কিন্তু ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার আর্নল্ডের বিরুদ্ধে একটি ফাউল না পেয়ে ক্ষেপে যান সুইস আন্তর্জাতিক ফুটবলার গ্র্যানিট ঝাকা। কনুই ও মাথা দিয়ে আলেক্সান্ডার আর্নল্ডকে আঘাত করেন তিনি। দুইজনই দেখেন হলুদ কার্ড। কিন্তু, এই ঘটনার সাথে সাথেই যেন জেগে ওঠে অ্যানফিল্ড। পরক্ষণেই মোহামেদ সালাহ পেয়ে যান গোল। এরপরের ফলাফল সবারই জানা। পরিস্থিতি অনুধাবন না করে হুট করে আর্সেনালের অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার ঝাকার মাথা গরম করার এই ঘটনার চড়া মাশুল সামনে আরও গুনতে হতে পারে গানারদের।
গার্দিওলার মাস্টারি:
পেপ গার্দিওলার অধীনে ম্যানচেস্টার সিটির ডাগআউটে সহকারী হিসেবে তিন বছর কাটিয়ে অনেক কিছুই শিখেছেন মিকেল আর্টেটা। শুরুতে আর্সেনালকে সাফল্য এনে দিতে না পারলেও ধৈর্যের ফল পেতে শুরু করেছে তার দল। দলকে দারুণভাবে খেলাচ্ছেনও আর্টেটা। তবে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আর্সেনালকে ৩-১ গোলে হারানোর ম্যাচে আরও একবার গার্দিওলা দেখিয়েছেন তার মাস্টারি। টাচলাইনের পাশে দাঁড়িয়ে প্রায় পুরো সময়ই চিৎকার করে শিষ্যদের প্রতি বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে দেখা গেছে আর্টেটাকে। অন্যদিকে, শান্ত স্বভাবের প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন গার্দিওলা।
ম্যাচটিতে সমতা রেখেই বিরতিতে যায় দুই দল। দ্বিতীয়ার্ধে নিজের পরীক্ষামূলক ৩-২-২-৩ ফরমেশন থেকে সরে চার ডিফেন্ডারে সরে যান গার্দিওলা। রিয়াদ মাহরেজের জায়গায় নামান ম্যানুয়েল আকঞ্জিকে। এতেই খেলায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ম্যান সিটি। দুইটি গোল করে ম্যাচও নিয়ে নেয় নিজেদের মুঠোয়। ঘরোয়া ফুটবলে গার্দিওলার অবিশ্বাস্য সাফল্য মোড়া রেকর্ডই জানান দেয়, মৌসুমের এরকম সময়ে খুব একটা ভুল করেন না বিশ্বের অন্যতম সেরা এই মাস্টারমাইন্ড। ২৭ এপ্রিল আবারও মুখোমুখি হবে এই দুই দল। সেই ফলাফল অনেকাংশেই প্রভাব রাখবে শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে। আর ডাগআউটে দাঁড়ানো পেপ গার্দিওলার প্রভাবও সেই ম্যাচে যে অনেকটাই থাকবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর্সেনালের কঠিন সূচি:
ম্যানচেস্টার সিটিকে খেলতে হবে আর্সেনালের বিরুদ্ধে। এছাড়াও ফুলহাম, ব্রাইটন, ব্রেন্টফোর্ডের বিপক্ষেও রয়েছে তাদের ম্যাচ। তবে সবগুলো ম্যাচ জিতে সম্ভাব্য সব পয়েন্টই যদি জিতে নেয় পেপ গার্দিওলার দল তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ, সিটিজেনরা এমন পারফরমেন্স আগেও বেশ কয়েকবারই দেখিয়েছে। সেই সাথে, চ্যাম্পিয়নস লিগ ও এফএ কাপের শিরোপার জন্য লড়ার মতো গভীরতা আছে তাদের স্কোয়াডে।
অন্যদিকে, আর্সেনালের এখন কেবল প্রিমিয়ার লিগই ধ্যানজ্ঞান। চাপও হয়তো অনুভূত হবে বেশি। রেলিগেশনের হুমকিতে থাকা ওয়েস্ট হ্যাম এবং সাউদাম্পটনের বিপক্ষে খেলবে গানাররা। ম্যান সিটির বিপক্ষে ম্যাচের আগে আর্সেনালের কাছে এই দুই প্রতিপক্ষকে হারানো ছাড়া উপায় নেই। সেই সাথে, এপ্রিলের শেষে চেলসিকে আতিথ্য দেবে মিকেল আর্টেটার দল। চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার সুযোগের অপেক্ষায় থাকা নিউক্যাসল ইউনাইটেডের বিপক্ষেও আছে আর্সেনালের ম্যাচ। এমিরেটসে ব্রাইটনের সাথে খেলবে গানাররা। এর বাইরে সহজ প্রতিপক্ষ হিসেবে বলা যেতে পারে নটিংহাম ফরেস্টের নাম। আর মৌসুমের শেষ ম্যাচে উলভসের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে আর্টেটার শিষ্যরা। জুলেন লোপেতেগুইয়ের অধীনে নিজেদের অনেকটাই ফিরে পেয়েছে উলভস।
সবগুলো ম্যাচই যদি আর্সেনাল জিতে যায় তবে ঘুচে যাবে তাদের ১৯ বছরের প্রিমিয়ার লিগের অপেক্ষা। তবে ম্যান সিটির পক্ষে বাজি ধরার লোকই হয়তো এখন পাওয়া যাবে বেশি। কারণ, ক্লিনিক্যাল পারফরমেন্সে মৌসুমের শেষে পূর্ণ পয়েন্ট নিজেদের ডেরায় নিয়ে আসার রেকর্ডে যে সিটির ধারেকাছেও নেই আর্সেনাল!
/এম ই
Leave a reply