মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পাকিস্তানি পাসপোর্ট পুড়িয়ে বিলেত থেকে ফিরে আসেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

|

ফাইল ছবি।

উন্নত জীবনের সন্ধানে দেশান্তরের ঘটনা অতি সাধারণ। অথচ সক্রিয়ভাবে রণাঙ্গনে থেকে দেশের জন্য লড়তে বিলেতের উন্নত জীবন ফেলে চলে এসেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস-এ অধ্যয়নরত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পাকিস্তানি হানদারদের বর্বরতার কথা জানতে পেরেই পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেশে ফিরে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ফিরে আসেন। নেন সমরাস্ত্রের প্রশিক্ষণ, গড়ে তোলেন ফিল্ড হাসপাতাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তার এই উদ্যম থামেনি। জীবনের সায়াহ্নেও ছিলেন কর্মমুখর।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে লন্ডনে ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। এপ্রিল মাসে হাইড পার্কের সমাবেশে ডা. জাফরুল্লাহ নিজের পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিড়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। তখন তিনি রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক। বৃটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ প্রত্যয়নপত্র নিয়ে সংগ্রহ করেন ভারতীয় ভিসা। নানা নাটকীয়তায় ফেরেন ভারতে।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’-তে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে লিখেছেন, ‘চেনা হয়ে উঠেছে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. এমএ মোবিন। এরা দুজনে ইংল্যান্ডে এফআরসিএস পড়ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বিলেতে চার বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর যখন এফআরসিএস পরীক্ষা মাত্র এক সপ্তাহ পরে, তখনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু। ছেলে দুটি পরীক্ষা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে অংশ নিলো, পাকিস্তানি নাগরিকত্ব বর্জন করলো, ভারতীয় ট্রাভেল পারমিট যোগাড় করে দিল্লিগামী প্লেনে চড়ে বসলো। উদ্দেশ্য ওখান থেকে কলকাতা হয়ে রণাঙ্গনে যাওয়া। প্লেনটা ছিল সিরিয়ান এয়ারলাইন্স-এর। দামাস্কাসে পাঁচ ঘণ্টা প্লেন লেট, সবযাত্রী নেমেছে। ওরা দুইজন আর প্লেন থেকে নামে না। ভাগ্যিস নামেনি। এয়ারপোর্টে এক পাকিস্তানি কর্নেল উপস্থিত ছিল ওই দুইজন ‘পলাতক পাকিস্তানি নাগরিককে’ গ্রেপ্তার করার জন্য।

প্লেনের মধ্য থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না, কারণ প্লেন হলো ইন্টারন্যাশনাল জোন। দামাস্কাসে সিরিয়ান এয়ারপোর্ট কর্মকর্তা ওদের দুইজনকে জানিয়েছিল- ওদের জন্যই প্লেন পাঁচ ঘণ্টা লেট। এমনিভাবে ওরা বিপদের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত মে মাসের শেষাশেষি সেক্টর টু রণাঙ্গনে গিয়ে হাজির হয়েছে।’

যুদ্ধক্ষেত্রে হতাহত বাড়তে থাকলে এবং উদ্বাস্তু ও নিযার্তনের শিকার বাঙালির মারাত্মক স্বাস্থ্য সংকট দেখা দিলে মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও  ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম জিএস ডা. এমএ মবিনকে নিয়ে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জের মেলাঘরে হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানে ৪৮০ শয্যার ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। নাম দেন- ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। হাসপাতালটির কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন বীরপ্রতীক ডা. সিতারা বেগম ।

হাসপাতালের জন্য ছিল না প্রশিক্ষিত নার্স। নারী স্বেচ্ছাসেবীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিয়ে হাসপাতালের জন্য প্রস্তুত করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সে হাসপাতালের দুই স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও তার বোন সাঈদা কামাল। বাঁশের তৈরি এই হাসপাতালে অসংখ্য মানুষকে সেবা দেয় হয়, প্রাণে বাঁচানো হয় অগণিত যুদ্ধাহতকে।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে বহনকারী যে হেলিকপ্টারটি হামলার শিকার হয়েছিল সেখানে ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতালটি গড়ে তুলেন কুমিল্লায়। পরে সেটা স্থানান্তর করেন ঢাকার অদূরে সাভারে। সে সময় নাম নিয়ে আপত্তি আসে প্রশাসনের তরফ থেকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’র নামও চূড়ান্ত করে দেন বঙ্গবন্ধু। কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ দিয়েছিলেন প্রায় ৩১ একর জমি ।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পাইলট প্রজেক্ট গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রাইমারি কেয়ার কনসেপ্ট মাঠে প্রমাণ করে এবং এর ভিত্তিতে হু আর ইউএনও আলমাআতা কনফারেন্সের মাধ্যমে গ্লোবাল ইউনিভার্সাল প্রাইমারি কেয়ার প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। গ্লোবাল প্যারামেডিক যে কনসেপ্ট তার অগ্রদূত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ট্রেইন্ড প্যারামেডিক দিয়ে মিনি ল্যাপারোটমির মাধ্যমে লাইগেশন সার্জারির উদ্ভাবক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এ সংক্রান্ত তার পেপারটি বিশ্ববিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট মূল আর্টিকেল হিসেবে ছাপা হয়। অনেক বছর যুক্তরাষ্ট্রের মূল পেডিয়াটিক্স টেক্সট বইয়ের একটি চ্যাপ্টার লিখেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। দেশে-বিদেশে তার লেখা বই ও পেপারের সংখ্যা প্রচুর। প্রাইমারি কেয়ার নিয়ে ডেভিড ওয়ার্নারের বই ‘যেখানে ডাক্তার নেই’ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন তিনি। বইটি বিপুল সমাদৃত হয়েছিল।

১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এই ওষুধ নীতির ফলে দেশের ওষুধ শিল্পে ঘটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

নানা সময়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার প্রস্তাব পেয়েছিলেন ডা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বিপরীতে বেছে নেন সাদামাটা জীবন। নাগরিক অধিকার আন্দোলনে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে তার দুটি কিডনিই প্রায় অকোজো। প্রতি সপ্তাহে একাধিকবার ডায়ালাইসিস করাতে হতো। কিন্তু তার কর্মমুখরতার পথে এই অসুস্থতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। নানা ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিতেন তিনি।


তার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার সর্বাধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে তোলেন। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং উন্নত যেকোনো দেশের সঙ্গে তুলনীয় এই কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার। খরচ একদমই কম। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন্য নামমাত্র মূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা নিশ্চিত করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

৮১ পার হওয়া শরীর। কিডনি জটিলতার পাশাপাশি অন্যান্য বার্ধক্যজনিত রোগও পেয়ে বসছিল। যদিও তিনি ছুটে চলছিলেন নিজের মতোই। সম্প্রতি, শরীর একদমই খারাপ হয়ে যায়। ভর্তি হন তার সার্বক্ষণিক কর্মস্থল নগর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে। সোমবার (১০ এপ্রিল) নেয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। তার আগে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনোভাবেই রাজি করানো যায়নি তাকে। দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে দেশের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন- এমন সিদ্ধান্তেই অনড় ছিলেন। মঙ্গলবার রাতে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা বৃথা করে দিয়ে চলে গেলেন এই কর্মবীর।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply