তাজনুর ইসলাম:
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সময়ের পরিক্রমায় যিনি ব্যক্তি থেকে হয়ে উঠেছেন ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের অধ্যায়ে তিনি নিজেই অনন্য এক ইতিহাস। নিভৃতচারী একজন দেশপ্রেমিকের নাম ডা. জাফরুল্লাহ। জনমভর যার মননে ছিল একটাই ভাবনা- দেশের কল্যাণ, দেশের মানুষের কল্যাণ। অর্জনের পাল্লা পাহাড়সম না হলেও এ দেশের মানুষের কাছ থেকে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জয় করেছেন অকৃত্রিম ভালোবাসা।
তিনি দেশকে ভালোবাসতেন, দেশের মাটিকে ধারণ করতেন বুকে। তাইতো এই ভূখণ্ডকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে একাত্তরে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ফেলে বিলেত থেকে ছুটে আসেন ডা. জাফরুল্লাহ। অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনে।
স্বাধীন দেশে তিনি হতে পারতেন দেশসেরা সার্জন। নামীদামী আর চাকচিক্যময় হাসপাতাল গড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন চিকিৎসাখাতের প্রধান ব্যবসায়ী হিসেবে। কিন্তু ভিন্ন ধাতুতে গড়া এক লড়াকু মানুষ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আজন্ম তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন গণ-মানুষের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে। জনকল্যাণধর্মী চিকিৎসা নীতির মাধ্যমে দেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি প্রণয়ন, জাতীয় শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে অগ্রসর শিক্ষা নীতি প্রণয়ন ও নারী উন্নয়নে রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা।
১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম। পৈত্রিক নিবাস সেখানে হলেও বড় হয়েছেন ঢাকায়। পিতামাতার দশজন সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। পড়াশোনা পুরান ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউট, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা মেডিকেলে। ১৯৬৪ সালে এমবিবিএস ও ১৯৬৭ সালে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসেন ডা. জাফরুল্লাহ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামে ফিরে শুরু করেন স্বাস্থ্যযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের যে ফিল্ড হাসপাতালটি গড়েছিলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে তা নতুন করে গড়ে তোলেন কুমিল্লায়। পরে তা স্থানান্তর করেন ঢাকার অদূরে সাভারে। এই ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামটি অবশ্য দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
দেশের চিকিৎসাখাত যখন পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে গিয়েছে, তখনও সত্যিকার অর্থেই সেবা দিয়ে যাচ্ছে ডা. জাফরুল্লাহর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। স্বাস্থ্যবীমা চালু আছে জন্মলগ্ন থেকেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঢাকার হাসপাতালে সন্তান প্রসবের মোট খরচ মাত্র ২ হাজার টাকা। দেশে সাধারণভাবে একবার কিডনি ডায়ালাইসিসের খরচ গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। ঠিক এই খরচ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা।
প্রথম জীবনে বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। দেশে-বিদেশে রয়েছে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। সুবিধাবাদী সুশীল নয় বরং একজন বিবেকবান বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার খ্যাতি দেশজোড়া।
জীবদ্দশায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদক’ অর্জন করেন। তার ঝুলিতে রয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সম্মানজনক নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।
এএআর/
Leave a reply