ইয়েমেনের রাস্তায় চলছিল একটি বাস। যাত্রীদের বেশিরভাগই স্কুলশিশু। হঠাৎ আকাশ থেকে এসে আঘাত করলো একটি বোমা। মুহূর্তেই ছিন্ন বিচ্ছিন হয়ে গেল বাসটি। আর যাত্রীরা? কেউ সাথে সাথেই জ্বলে অঙ্গার। বিস্ফোরিত বোমার ধোঁয়ার কুণ্ডুলি আবছা হয়ে আসতেই দেখা গেলে চারদিকে শিশুদের লাশ, শরীরের টুকরা। হাত এক জায়গা, পা অন্য জায়গায়। কারো মাথা পড়ে আছে আলগা হয়ে। কেউবা কাতরাচ্ছে শব্দহীনভাবে, কারো শরীর পড়ে আছে নিথর।
এটি ছিল গত বৃহস্পতিবার যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের সা’দা প্রদেশে একটি রাস্তার দৃশ্য। স্কুল পড়ুয়া শিশুদের বহনকারী বাসে হামলা বোমা মেরেছিল সৌদি-আরব নেতৃত্বাধীন জোট। এতে ২৯ শিশু নিহত এবং ৩০ শিশু আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি)। বিদ্রোহী হুতি মুভমেন্ট পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মৃতের সংখ্যা সব মিলিয়ে ৪৩ এবং আহতের সংখ্যা ৬১ উল্লেখ করেছে।
রেডক্রস জানিয়েছে, প্রাদেশিক হাসপাতালে ২৯ শিশুর মৃতদেহ নেওয়া হয়েছে। তাদের সবারই বয়স ১৫ বছরের কম। এছাড়া আহত আরো ৪৮ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ৩০ জনই শিশু।
শিশু হত্যার উপরের এমন দৃশ্য বিশ্ববাসীর কাছে নতুন নয়। বহু বছর ধরে দখলদার ইহুদীবাদী ইসরায়েলের হাতে এমন হত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিশেষ করে দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু তার গত দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সময়ে ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষ ও শিশুদের ওপর বর্বরতা চালিয়ে ‘শিশু হত্যকারী’ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন।
ইয়েমেনের সর্বশেষ ঘটনায় এত সংখ্যক শিশু হত্যার পর প্রশ্ন উঠেছে যার একক উদ্যোগে ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িয়েছে সৌদি আরব সেই যুবরাজ বিন সালমানও কি ‘শিশু হত্যাকারী’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন না?
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সচেতনভাবে বোমা ফেলে এতগুলো শিশু হত্যার মতো বর্বর কাণ্ড ঘটিয়েও এতটুকু ‘দুঃখিত’ নয় মুসলিম বিশ্বের কথিত নেতা সৌদি আরব! হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে সৌদি জোটের মুখপাত্র কর্নেল তুর্কি আল-মালকি বলেছেন, ‘হামলাটি আন্তর্জাতিক আইন মেনে বৈধভাবেই চালানো হয়েছে। এর লক্ষ্য ছিল ওই জঙ্গিরা যারা বুধবার রাতে দক্ষিণাঞ্চলীয় সৌদি নগরী জিজানে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিল।’
জঙ্গিদের ওপর হামলা করতে গিয়ে স্কুলশিশুদের বহন করা বাসে হামলা এবং অন্তত ২৯ শিশু নিহত। আর বিন সালমানের নিয়োগকৃত কর্মকর্তা বলছেন, এই খুন ‘আইন সম্মতভাবেই’ হয়েছে! ইসরায়েলের নেতানিয়াহুও কখনো এত শিশু হত্যার পর এমন নির্লজ্জ মন্তব্য করেছেন কিনা সন্দেহ!
হুতি মুভমেন্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ আব্দুল-সালাম বলেছেন, কোয়ালিশন বাহিনী বেসামরিক নাগরিকের জীবনকে আমলেই নেয়নি। তারা নগরীর একটি ব্যস্ত জনসমাগম এলাকায় হামলা চালিয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে বেসামরিক নাগরিকদের অবশ্যই সুরক্ষিত রাখতে হবে বলে উল্লেখ করেছে রেডক্রস। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এ হামলাকে ‘ভয়াবহ’ আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে ঘটনাটির পূর্ণ ও নিরপেক্ষ তদন্ত আহ্বান করেছে।
ইরানের মদদপুষ্ট হুতি বিদ্রোহীদের দমানোর নামে তিন বছর আগে শুরু করা ইয়েমের যুদ্ধে নিজ দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্য কারো জন্যেই কোনো ভালো ফল এখনও এনে দিতে পারেন নি বিন সালমান। দরিদ্র দেশটিতে ইরানের প্রভাব আগের চেয়ে একটু না কমে বরং সৌদি হামলার মুখে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকরা ধীরে ধীরে ইরানের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। এক কোটির বেশি মানুষ প্রতিদিন অনাহারে বা অর্ধাহারে কাটাচ্ছেন। দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রায়। অন্তত ২০ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
অন্যদিকে হুতিরা কোনো অংশেই আগের চেয়ে দুর্বল হয়নি। বরং গত এক বছরে তারা বেশ কয়েকবার সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদসহ একাধিক প্রদেশে ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে, যা তিন বছর আগে কল্পনাও করা যায়নি। এতে সৌদি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
ইয়েমেন যুদ্ধের তিন বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে এখনও উল্লেখ করার মতো কোনো সাফল্য না পেলেও সম্ভবত একটি সাফল্য ইতোমধ্যে অর্জন করেছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। আর তা হলো ‘শিশু হত্যাকারী’ এর উপাধি।
Leave a reply