১ জুন রংপুর বিভাগ জুড়ে ‘স্তব্ধ কর্মসূচি’র ঘোষণা

|

স্টাফ করেসপনডেন্ট, রংপুর:

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের গণ সমাবেশে বক্তারা বলেন, আসন্ন বাজেটেই নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিতে হবে। উজানে খাল খনন প্রকল্প বন্ধসহসহ ৬ দফা বাস্তবায়ন করা না হলে কঠোর আন্দোলনে যাবে তিস্তাপাড়ের মানুষ।

শনিবার ( ৬ মে) বিকেলে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে পরিষদের গণ সমাবেশে এ কথা বলেন বক্তারা। ঘোষণা দেন দাবি আদায়ে তিস্তার দুই তীরসহ রংপুর বিভাগ জুড়ে ১ জুন স্তব্ধ কর্মসূচি পালন করা হবে। ওইদিন সব গাড়িঘোড়া, দোকানপাট সব কিছু বন্ধ করে যে যেখানেই আছেন সেখানেই স্তব্ধ হবেন।

গণসমাবেশের উদ্বোধন শেষে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, পদ্মা সেতু যদি দেশের টাকায় নির্মাণ করা সম্ভব হয়, তাহলে তিস্তা মহাপরিকল্পনাও বায়স্তবায়ন করা সম্ভব। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাহসী পদক্ষেপের কারণে আমাদের দেশের মানুষের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়েছে। ওই পদ্মা সেতুতে রংপুর বিভাগের মানুষের ট্যাক্স ও ভ্যাটের টাকা দেয়া রয়েছে। বর্তমানে দেশে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। কিন্তু উত্তরের মানুষের জন্য কোনো মেগাপ্রকল্প নেই। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার ঘোষিত তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চাই।

সংসদে রংপুর অঞ্চলের এমপি-মন্ত্রীরা মনোনয়ন হারাবার ভয়ে তিস্তা নিয়ে কথা বলেন না অভিযোগ তুলে সিটি মেয়র মোস্তাফিজার বলেন, আমরা চীন-ভারত বুঝি না। পদ্মা সেতুর মতো আমরা নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। এটি গণমানুষের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমাদের এমপি-মন্ত্রীরা সংসদে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিস্তার দাবি তুলে ধরতে ভয় পায়। কারণ তারা মনোনয়ন হারানোর ভয় করে। যারা জনগণের গণ দাবি নিয়ে কথা বলতে চান না তাদেরকে রংপুরের মানুষ আগামীতে লাল কার্ড দেখাবে।

গণসমাবেশে রাশেদ খান মেনন বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমরা তার উদ্যোগে আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু আফসোস সেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। আজ তিস্তা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চরের ওপর চর পড়েছে। আর ভাঙনের পর ভাঙনে তিস্তাপাড়ের মানুষ আজ নিঃস্ব।

সাবেক এ মন্ত্রী আরও বলেন, তিস্তা আমার নদী, আমাদের নদী। তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন আমাদের সবার দাবি, এটা আমাদের প্রাণের দাবি। এরমধ্যে যারা নিরাপত্তা, ভূ-রাজনীতি ও চীন-ভারতের সম্পর্কের প্রশ্ন খুঁজে, আমি তাদের বলবো, এই খেলা আমাদের নিয়ে লেখবেন না। তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন কোন চক্রান্ত, বাঁধা আমরা মানবো না। আগামী জাতীয় বাজেট অধিবেশন আমরা সংসদেও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ চাইবো।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে উত্তরবঙ্গের মঙ্গা দূর হয়েছে। আপনার (শেখ হাসিনার) হাত ধরেই আপনার ঘোষিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এবারের বাজেটে টাকা চাই। এবারের বাজেটে আমাদের এক নম্বর দাবি হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনার জন্য টাকা দাও, টাকা দাও। ইনু বলেন, তিস্তার পানি ভারত থেকে আসে। সেটা নিয়ে পানি চুক্তির ব্যাপার রয়েছে। ২০১২ সালে ভারত-বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক থেকে তা নিয়ে সমঝোতা হয়েছে। তিস্তার পানি চুক্তি হবে বলে একমতও হয়েছে ভারত। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতিবছর সরকার তাগাদা দিচ্ছে কিন্তু হচ্ছে হচ্ছে করেও হচ্ছে না। আমরা শুধু তিস্তার পানি চুক্তি চাই না, আমরা চাই তিস্তা মহাপরিকল্পনারও বাস্তবায়ন হোক।

সভাপতির বক্তব্যে পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর বসবাস রংপুরে। তারপরও বিশেষ কোনো বরাদ্দ ও ব্যবস্থা নেই এদের জন্য। বরং রংপুরকে পিছিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দের ১ শতাংশের চেয়ে কম বরাদ্দ রংপুর বিভাগের জন্য দেয়া হয়। দেশে চলমান তিন লাখ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প চললেও রংপুর বিভাগের জন্য কোনো মেগাপ্রকল্প নেই। তিস্তা সুরক্ষায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার কথা বলা হয়েছে। অথচ তিস্তা নদীর ভাঙন-বন্যায় প্রতিবছর যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ নিঃসন্দেহে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার বহুগুণ বেশি। এ মূহূর্তে সরকারের উচিত হবে, সাড়ে আট হাজার কোট টাকা ব্যয় করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তার পরিচর্যা নিশ্চিত করা। এটি হলে প্রতি বছর ভাঙন ও বন্যা থেকে রক্ষা পাবে হাজার হাজার কোটি টাকা। রংপুরের সাথে সারাদেশের বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্যেও তিস্তা সুরক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

গণসমাবেশে তিস্তা অববাহিকার রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলা থেকে আগত তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন তিস্তা সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

এ সময় তারা ছয় দফা তুলে তিস্তার ভাঙন, বন্যা ও খরায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ, ভাঙনের শিকার ভূমিহীন গৃহহীনদের পুনর্বাসন, তিস্তা নদী সুরক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত খনন, মহাপরিকল্পনায় তিস্তা নদী ও নদী তীরবর্তী কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষায় ‘কৃষক সমবায় এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পকলকারখানা’ স্থাপন, তিস্তা নদীর শাখা-প্রশাখা ও উপ নদীগুলোর সঙ্গে পূর্বেকার সংযোগ স্থাপন এবং দখল-দূষণ মুক্তকরণ এবং নৌ চলাচল পুনরায় চালু ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দাবি জানান।

তারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা শুনে আসছি। আজ পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। অর্থ বরাদ্দ হয়নি। আর কিছুদিন পর ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপিত হবে। মাত্র সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার জন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা আলোর মুখ দেখবে না, এটা আমরা বিশ্বাস করি না। তিস্তার সাথে রংপুর অঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। আমরা চীন-ভারত বুঝি না। নিজস্ব অর্থায়নে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আসন্ন বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। যদি এটি করা না হয় তাহলে অচিরেই বৃহত্তর আন্দোলন ও সংগ্রামের কর্মসূচি দেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, তিস্তা অবববাহিকার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের উপস্থিতিতে পাবলিক লাইব্রেরী মাঠের গণসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। গণসমাবেশে দাবি আদায়ে তিস্তার ২৩০ কিলোমিটারসহ রংপুর বিভাগের প্রতিটি হাটবাজারে ১ লা জুন সকাল ১০ টা থেকে ১০ টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ৫ মিনিটের স্তব্ধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন পরিষদ সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী। ওই সময় গাড়িঘোড়া, অফিস আদালত, সব জায়গায় সবাইকে সব কাজ বন্ধ করে ৫ মিনিট স্তব্ধ হয়ে থাকার আহবান জানান তিনি। এছাড়া দাবি আদায়ের সপক্ষে জনমত সৃষ্টিতে প্রতিটি জেলায় সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply