ঢাকাই চলচ্চিত্রে নায়ক ফারুকের আলোচিত যাত্রা

|

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাই সিনেমার কিংবদন্তি চিত্রনায়ক ফারুক আর নেই। ৭৪ বছর বয়সে আজ (১৫ মে) সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিরপ্রস্থান করেছেন তিনি। প্রায় তিন দশক অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রাঙ্গনে ‘মিয়া ভাই’ হিসেবে পরিচিত এই অভিনেতা। লাঠিয়াল, সুজন সখী, নয়নমনি, সারেং বৌ, গোলাপী এখন ট্রেনে, সাহেব, আলোর মিছিল, দিন যায় কথা থাকে, মিয়া ভাই-সহ শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন ফারুক। লাঠিয়াল চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ১৯৭৫ সালে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। কিংবদন্তি এই নায়ক ২০১৬ সালে আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন।

চলচ্চিত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুকের অভিষেক হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বছর ১৯৭১ সালে, জলছবি সিনেমার মধ্য দিয়ে। এইচ. আকবর পরিচালিত সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ। এতে তার সহশিল্পী ছিলেন কবরী সারওয়ার। ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা আবার তোরা মানুষ হ সিনেমায় অভিনয় করেন ফারুক। এতে তার সহশিল্পী ছিলেন ববিতা।

পরের বছর, ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচিত ও প্রশংসিত সিনেমা আলোর মিছিল এ অভিনয় করেন ফারুক। এতে অন্য অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন রাজ্জাক, ববিতা, সুজাতা।

আলোর মিছিল সিনেমার পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৫ সালে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত সুজন সখী সিনেমায় ‘সুজন’ ভূমিকায় ছিলেন ফারুক। ছবিতে সখী নামধারী নায়িকা ছিলেন কবরী। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ছবিটি বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন করা হয়। পরবর্তীতে এই ছবি রিমেকও করা হয়েছে।

সুজন সখী চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

একই বছর মুক্তি পায় ফারুক অভিনীত আরেকটি আলোচিত চলচ্চিত্র লাঠিয়াল। প্রখ্যাত পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত সিনেমায় অন্য অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন আনোয়ার হোসেন, ববিতা। লাঠিয়াল‘এ ‘দুখু মিয়া’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন ফারুক।

১৯৭৬ সালে আমজাদ হোসেন পরিচালিত নয়নমনি তে ‘নয়ন’ ভূমিকায় অভিনয় করেন ফারুক। তার সহশিল্পী ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম ও ববিতা।

দুই বছর পর ১৯৭৮ সালে আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত সারেং বৌ সিনেমায় কদম সারেংয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে আরও একবার দর্শকদের হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নেন ফারুক। শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত এই চলচ্চিত্রে ফারুকের বিপরীতে ছিলেন কবরী।

গোলাপী এখন ট্রেনে সিনেমার একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

একই বছর আমজাদ হোসেনের উপন্যাস ‘দ্রৌপদী এখন ট্রেনে’ অবলম্বনে তার পরিচালনায় নির্মিত গোলাপী এখন ট্রেনে নামক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ফারুক। বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত এই সিনেমায় তার সহশিল্পী ছিলেন ববিতা ও আনোয়ার হোসেন। এই সিনেমায় ‘গোলাপী’ চরিত্রে ছিল একটি আলোচিত সংলাপ। ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় উঠে পড়ার পর গোলাপীকে চলে যেতে বলায় তার মুখে শোনা যায়, ‘বাংলাদেশে কোনো কেলাস নাই গো। আমরা হগগলেই এক কেলাসের মানুষ।’

১৯৯১ সালে চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় পদ্মা মেঘনা যমুনা সিনেমায় হাসুর ভূমিকায় অভিনয় করেন ফারুক, যাতে তার বিপরীতে ছিলেন ববিতা।

এখনো অনেক রাত চলচ্চিত্রের পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৭ সালে খান আতাউর রহমানের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়ের চিত্র তুলে ধরা ছায়াছবি এখনো অনেক রাত এ ‘জাহেদ’ চরিত্রে অভিনয় করেন ফারুক। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও একবার এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায়। এখানে দেখানো হয় সম্মুখ সমরের চিত্র। যুদ্ধের সেই বিভীষিকা শেষে মুক্তি পায় স্বাধীন বাংলাদেশ। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে আসে জাহেদ, কামাল, সাব্বিররা। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সবকিছুতেই অপূর্ণতা প্রত্যক্ষ করে হতাশ হয় তাদের মতো অনেকেই। স্বাধীনতা বিরোধিতাদের উত্থানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ম্লান হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট শৈল্পিকভাবে দেখানো হয় সেখানে। যুদ্ধের বিশ বছর পর জাহেদকে পাবনায় পাগলাগারদে আবিষ্কার করা হয়। তার কণ্ঠে ছিল আলোচিত সংলাপ, ‘এখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি, এখনও ভোর হয়নি, এখনও অনেক রাত।’ এই চলচ্চিত্রে ফারুকের সহশিল্পী ছিলেন ববিতা, সুচরিতা, আগুন, বুলবুল আহমেদ।

ফারুক সর্বশেষ দুটি সিনেমা করেছিলেন ২০০৬ ও ২০০৮ সালে। এফআই মানিকের কোটি টাকার কাবিন মুক্তি পায় ২০০৬ সালে। আজাদী হাসনাত ফিরোজের পরিচালনায় ২০০৮ সালে নির্মিত ঘরের লক্ষ্মী ফারুক অভিনীত শেষ ছবি। তিন দশকব্যাপী বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের মন জয় করে নেয়া এই অভিনেতা দেশের ইতিহাসে অন্যতম সফল ও সেরা নায়ক হিসেবে স্বীকৃত।

/এম ই


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply